মোহাম্মদ মাহবুব হোসাইন:
৯০ এ স্বৈর শাসক জেনারেল হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের পতনের মধ্যদিয়ে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী সংগঠন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সরাসরী সমর্থনে বাংলাদেশের রাস্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর তাদের প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে নানাভাবে বিব্রত করার জন্য নানা কুটকৌশলের আশ্রয় নেয়। সেই কুটকৌশলের প্রথম অধ্যায় ছিল দেশের সংবিধান পরিপন্থি জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ফ্যাসীবাদী অপসংগঠন “৭১ এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি” বা ঘাদানিক প্রতিষ্ঠা করা।
এই সংগঠনটি সৃষ্টির পর থেকেই সারা দেশে যুদ্ধাপরাধের ধুয়া তুলে জ্বালাও পোড়াও কর্মসূচী শুরু করে দেয়। এই নৈরাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে সেই সময় একদল সাহসী যুবক রাজপথে নেমে আসে এবং ১৯ জানুয়ারী ১৯৯২ গঠন করে সময়ের সাহসী সন্তানদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত সংগঠন জাতীয় যুব কমান্ড ।এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে আমি একজন। ঘাদানিকের সকল অপতৎপড়তার বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান এই ঘোষনার মধ্য দিয়ে আমরা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সারা দেশে কর্মসূচী ঘোষনা করি।
আমাদের কর্মসূচীকে আরও বেগবান করার জন্য সমমনা রাজনৈতিক দলের অভিজ্ঞ নেতৃবৃন্দের সাথে আমরা যোগাযোগ শুরু করি। এরই ধারাবাহিকতায় আমি আমাদের সংগঠনের সভাপতি বি এম নাজমুল হক, সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহিল মাসুদ সেক্রেটারি জেনারেল আবু নাসের মোহাম্মদ রহমাতুল্লাহ সহ আরও কয়েকজন সদস্য ১৬ এপ্রিল ১৯৯২ সকাল ১০ টায় বর্ষীয়ান রাজনীতিবীদ শহীদ সালাহউদ্দীন কাদের চৌধুরীর ঢাকার ধানমন্ডিস্থ বাসায় সৌজন্য সাক্ষাৎকারের জন্য যাই। মূল লক্ষ্য ঘাদানিক নিষেদ্ধের দাবীতে ঘোষিত ১৮ এপ্রিল ১৯৯২ সারা দেশে হরতাল এর পক্ষে সর্মথন আদায় । আমরা চা পান করার মধ্যেই তিনি আসলেন এবং উচ্চস্বরে বলছিলেন, কই যুব কমান্ড ? এর পর র্দীঘ ৩ ঘন্টা তাঁর সঙ্গে দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের আলোচনা হয়।এই তিন ঘন্টা আমরা অধিকাংশ সময়ই শহীদ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কথাই শুনছিলাম।সেদিন তার সাথে কথা বলে আমার কাছে মনে হয়েছিল, তিনি রাজনীতি ,ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ মানুষ। যতটা মনে পরে লুঙ্গি ও সফেদ পাঞ্জাবি পরা অবস্থায় কথা শেষে তিনি আমাদের মেইন গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেন।
এর পর থেকে আমি তাঁর অনেক বক্তব্য শুনেছি ; যা দেশের সকল রাজনীতিবীদদের চেয়ে অনেকটা ভিন্ন মাত্রার। তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভিন্ন সময়ে বক্তব্য দিয়ে ঝড় তুলেছেন। এসব রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে আমার মূল্যায়ন; তিনি যা বলতেন তা অমুলক কিছু বলতেন না। যদিও কথা গুলো অনেকটা খোলামেলা ভাবে বলতেন। তবে তাঁর কথা গুলো ছিল সত্যের নির্যাস । তাঁর মতো এমন সাহস করে এভাবে কেউ কথা বলতে পারবেনা কিংবা বলার সাহস দেখাতে পারবে বলে আমি মনে করিনা। তাঁর বিরুদ্ধে অনেকেই বলেন , তিনি বদমেজাজি এবং অহংকারী হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করতেন।কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পুর্ন ভিন্ন । তাঁর মতো বন্ধুবাৎসল্য এবং আড্ডাবাজ প্রিয় মানুষ আমি আমার জীবনে কমই দেখেছি। এ কথা সত্য কোন বদমেজাজি কিংবা অহংকারী লোক আড্ডাবাজ হতে পারেনা। তিনি ছিলেন একজন বড় মাপের পার্লামেন্টেরিয়ান। আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও আইনের বিষয়ে ছিল তাঁর প্রচুর পড়াশুনা।
আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে ১৯৯৬ এ আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় যেয়ে দৈনিক ইনকিলাবের উপর খড়গহস্ত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ইনকিলাব সম্পাদক এম এম বাহাউদ্দিন ভাইয়ের বিরুদ্ধে একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার। বাহাউদ্দিন ভাই আগাম জামিন নেওয়ার জন্য অতিগোপনে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে হাইকোর্ট এ চলে আসেন। সরকার বাহাউদ্দিন ভাইকে গ্রেফতার করবেই এমন এক প্রেক্ষাপটে দেশের জাতীয়তাবাদী শক্তির কেন্দ্রীয় নেতাদের ব্যাপক সমাগম ঘটে হাইকোর্ট আঙ্গিনায়। এ সময় বাহাউদ্দিন ভাইয়ের পাশে আমিও ছিলাম দেশপ্রেমিক জনতার মুখপত্র দৈনিক ইনকিলাবকে ভালবেসে।যদিও পরবর্তীতে বাহাউদ্দিন ভাইয়ের প্রশ্নিবদ্ধ ভুমিকায় জাতি হতবাক হয়েছিল এবং ইনকিলাব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।ইনকিলাবের সেই বেদনাদায়ক প্রসঙ্গ আমার মূল আলোচনার বিষয় নয়। আদালতের লবিতে উপস্থিত জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও সমাজের বিভিন্ন অঙ্গন থেকে আসা সিভিল সোসাইটির সকলেই চিন্তিত। কি যে ঘটে বাহাউদ্দিন ভাইয়ের ভাগ্যে। এমন সময় শহীদ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আগমন। হাসতে হাসতে তিনি কথার অবতারনা শুরু করলেন; সবাই রীতিমত নরেচরে দাঁড়ালো। তিনি বললেন, মওদুদ (সাবেক উপ রাষ্ট্রপতি ও বিএনপি নেতা) ভাই কিচ্ছু হবেনা। এ কথা বলে তিনি মার্কিন আদালতের একটা ঐতিহাসিক মামলার রায়ের কথা বললেন। এরই মধ্যে বাহাউদ্দিন ভাইয়ের মামলার শুনানীর জন্য মাননীয় আদালতের কার্যক্রম শুরু করে। আমরা আইনজীবীদের সাথে আদালত কক্ষে প্রবেশ করি। ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদ মামলার শুনানীতে অংশ নেন। তাকে সহায়তা করেন সাবেক এমপি সিনিয়র এডভোকেট খন্দকার মাহবুব উদ্দিন ও ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া সহ আরও অনেকে। অবাক করার বিষয় হলো , শহীদ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী কিছুক্ষন আগে আদালত লবিতে মার্কিন আদালতের যে কথা আলোচনা করেছেন ,ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদ সেই রেফারেন্স এর আলোকে প্রেস অব ফ্রিডমের অধিকারের প্রশ্ন নিয়ে তাঁর যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেন। মাননীয় আদালত তারই উপর ভিত্তি করে বিভক্ত রায় দেন।পরবর্তীতে মধ্য রাতে হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপিত আদালত মাননীয় প্রধান বিচারপতির উপস্থিতিতে পূর্নাঙ্গ রায় দিয়ে ইনকিলাব সম্পাদক এম এম বাহাউদ্দিন এর জামিন মঞ্জুর করেন। এই রায় ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা । এই রায়ের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে অনুমান করা যায়; কেমন উচ্চ চিন্তার মানুষ ছিলেন শহীদ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী।
জেনারেল মঈন উ আহমেদ এর সেনা শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর মতো সাহসী বক্তব্য অনেকেই দিতে পারেনী বলে তৎকালিন সময়ে দেশের মানুষ দেখেছে। আমি দেশ ত্যাগের পুর্বে তাঁর সাথে আমার সর্বশেষ দেখা হয় আমার সাংবাদিকতা জীবনের শিক্ষক সাবেক মন্ত্রী মরহুম আনোয়ার জাহিদ এর স্মরন সভায়। অনুষ্ঠানের মডারেটর হিসেবে হিসেবে আমি দায়িত্ব পালন করেছিলাম।সেদিন তিনি যে একাডেমিক বক্তব্য দিয়েছিলেন তা সত্যি অনবদ্য ছিল। সেদিন অন্য রকম একজন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে আমরা দেখেছিলাম। আমি আমার মোবাইলে তাঁর বক্তব্য রেকর্ড করেছিলাম। এখনও সুযোগ পেলেই তাঁর সেই আলোচনা শুনি আর ভাবী, এতো বড় মাপের একজন দেশপ্রেমিককে একটি অবৈধ তথাকথিত জঘন্য ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে হত্যা করলো।
দেশের মানুষ আর কখনোই শুনবেনা একজন সাহসী শহীদ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কন্ঠে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী হুংকার কিংবা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দুর্দিনে তাঁর পাশে এসে আর দাঁড়াবেনা অকুতোভয় লড়াকু মানুষটি।একজন শহীদ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্মৃতি এদেশের দেশপ্রেমিক জনতা যুগের পর যুগ তাদের হৃদয়ে ধারন করে দেশ বিরোধী অপশক্তির সকল ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে দেশের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখবে।
আজকের দিনে ২২ নভেম্বর ২০১৫ আওয়ামীলীগ অন্যায়ভাবে তথাকথিত অবৈধ ক্যাঙ্গারু আদালত দিয়ে জুডিশিয়াল কিলিংয়ের মাধ্যমে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ফাঁসির নামে হত্যা করেছিল।
মহান আল্লাহ আমাদের প্রিয়জন শহীদ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী’র উপর রহম দান করুন।
লেখকঃ সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী