তানভীর আহমদ তোহা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে সমাজের প্রায় সব পক্ষের ব্যাপক মনোযোগ প্রমাণ করেছে যে, শান্তিপূর্ন ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলেও বাংলাদেশ এখনো একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত হতে সম্ভবত আরও ৩০ বছর লাগবে ! একটি রাষ্ট্রের অসংখ্য মৌলিক সমস্যা ও তার সমাধান কি শুধুমাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ভেতর দিয়ে নির্ধারণ করা সম্ভব? তবু গত মাসখানেক ধরে গণমাধ্যমগুলো প্রায় একচেটিয়াভাবে ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরেই সরব থেকেছে। এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেন এই নির্বাচন হয়ে গেলেই দেশের সব সংকট দূর হয়ে যাবে।ইউরোপের যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জাতীয় নির্বাচনেও এতটা হৈচৈ দেখা যায় না ;যতটা এবারকার ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে হয়েছে।
শেখ হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে নানা কারণে এই নির্বাচন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে ফ্যাসিবাদোত্তর নতুন বাংলাদেশের নেতৃত্বকে তরুণেরা কেমন দেখতে চায় তার একটি স্পষ্ট চিত্র ফুটে উঠেছে এই নির্বাচনের মাধ্যমে। এবারের ডাকসু নির্বাচনে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে নেতাকর্মীদের মধ্যে ‘মুনিব-গোলাম’ সম্পর্কের সংস্কৃতির অবসান ঘটতে যাচ্ছে এমন বার্তাও স্পষ্ট হয়েছে ।
যাহোক এই নির্বাচনে ছাত্রশিবির-সমর্থিত প্যানেলের কাছে হেরেছে ছাত্রদল, বাগছাসসহ অন্যান্য সংগঠনের প্রার্থীরা। প্রকৃতপক্ষে ডাকসুতে জয়ী হয়েছে বাংলাদেশের হারানো গণতন্ত্র, চব্বিশের রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থান এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী সংগ্রামের চেতনা। বিগত ১৭ বছরে শেখ হাসিনা যাদের গুম-খুন করে ফ্যাসিবাদী রাজনীতিকে টিকিয়ে রেখেছিলেন; সেই ইসলামী ছাত্রশিবিরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের প্রাপ্য সম্মান ও কৃতজ্ঞতা জানাতে বিন্দুমাত্র ভুল করেনি। ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের তরুণরা যে রক্ত দিয়েছেন, সেই রক্তঋণ শোধ করার এক প্রচেষ্টা ছিল ঢাবি শিক্ষার্থীদের এই ভোট বিপ্লব ।
এবারের নির্বাচনে ছাত্রশিবিরও তাদের প্যানেলে যথেষ্ট কৌশলী ছিল। বিশেষ করে নারী প্রার্থী ফাতিমা তাসনিম ঝুমা এবং চাকমা প্রার্থী সর্বমিত্রকে অন্তর্ভুক্ত করে তারা ইনক্লুসিভ রাজনীতির এক শক্তিশালী বার্তা দিয়ছে।ছাত্রশিবিরের এই প্যানেল নির্বাচন আগামীতে জামায়াতের নির্বাচনী রাজনীতিতে হয়তো পথ দেখাতে পারে।
ছাত্রশিবিরের তুখোড় বির্তাকিক এসএম ফরহাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের জিএস প্রার্থী হামিমও ছিলেন অত্যন্ত যোগ্য। শিক্ষার্থীদের প্রতি তার দায়বদ্ধতা এবং পতিত ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান তাকে ছাত্রদলের প্যানেলের অন্য সবার থেকে একটু আলাদা করেছে। বিশেষ করে ভোটে পরাজিত হওয়ার পরও তিনি বাংলাদেশের নোংরা রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাইরে গিয়ে যে গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার দেখিয়েছেন তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। বলা যায়, হামিম যদি রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন তবে ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক ধারায় একটি প্রাসঙ্গিক নেতৃত্ব হিসেবে উঠে আসবেন।
ভিপি প্রার্থী আবিদ ছিলেন চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রনেতা। শুরুতে তিনি যথেষ্ট আলো ছড়ালেও সাদিক কায়েমের সরল ও নির্ভেজাল ব্যক্তিত্বের কাছে আবিদের অসলগ্ন শরীরী ভাষা তাকে অনেকটা ম্লান করে তুলেছিল । তবুও আবিদের লড়াকু মানসিকতা প্রমাণ করে তিনি ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীদের কাছে আরও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারবেন।
এই নির্বাচনে ছাত্রদলের প্রার্থীদের পরাজয়ের পেছনে তাদের নিজস্ব দুর্বলতার চেয়ে বড় কারণ ছিল দলীয় নেতাকর্মীদের নানা অপকর্ম। ৫ তারিখের অভ্যুত্থান-পরবর্তী বিএনপির কর্মকাণ্ডও ভোটের ব্যবধান বাড়াতে প্রভাব ফেলেছে। অথচ জিয়াউর রহমানের আমলে ছাত্রদল ডাকসুসহ হল সংসদ নির্বাচনে তাঁর ইতিবাচক ইমেজ ব্যবহার করে ব্যাপক জয় পেয়েছিল।স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী শামীমও তার বাগ্মীতা এবং ভিন্নধর্মী বক্তব্য দিয়ে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের মনে একধরনের আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।
সবশেষে বলা যায়, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান যে বাংলাদেশের ডানপন্থার এক নতুন উন্মেষ ঘটিয়েছে এবং ডাকসু নির্বাচন তার স্থায়ী রূপ নিশ্চিত করেছে। একইসঙ্গে ইসলামী ছাত্রশিবিরের জয় প্রমাণ করেছে যে দেশে ইসলামপন্থা আরও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠছে। এখন দেখার বিষয়, জামায়াতে ইসলামী এই নতুন বাস্তবতাকে কীভাবে গণরাজনীতিতে কাজে লাগায়।
বড় দল হিসেবে বিএনপির জন্য এই নির্বাচনে পাহাড়সম ক্ষতি না হলেও একটি গুরুতর সতর্কবার্তা আছে। যদি বিএনপি আগামী দিনে চব্বিশের পরাজিত ও পলাতক রাজনৈতিক শক্তির বয়ান পুনরুজ্জীবিত করতে চায় কিংবা তাদের অঙ্গসংগঠন ছাত্রদলকে প্রথাগতভাবে ব্যবহার করতে থাকে তবে পরিস্থিতি হয়তো বিএনপির প্রত্যাশিত রাজনৈতিক সমীকরণের অনেক বাইরে চলে যেতে পারে। ডাকসু নির্বাচন বিএনপিকে সেই বার্তাই দিয়েছে।
লেখক : প্রধান সম্পাদক ,তেঁখ বাংলা