বাংলাদেশ যেভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগ আকৃষ্ট করছে

ডেস্ক রিপোর্ট:

বিদেশিদের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার মাধ্যমে বাংলাদেশ নিঃশব্দে নিজেকে একটি কৌশলগত অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে তুলছে। বৃহস্পতিবার দ্য ডিপ্লোম্যাট এক নিবন্ধে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীন বর্তমানে বিনিয়োগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তারা চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত দুটি নতুন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে, যেখানে টেক্সটাইল, সিরামিক ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিপণ্য উৎপাদন করা হবে। তবে, বাংলাদেশে দক্ষিণ কোরিয়ার ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি একটি বৃহত্তর কৌশলগত সংযোগের ইঙ্গিত দেয়, যা একদিকে বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরের আকাঙ্ক্ষা এবং অন্যদিকে উভয় দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অভিলাষকে কাজে লাগাচ্ছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার মোট বিনিয়োগ বর্তমানে প্রায় ১.৫৬ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম বিদেশি বিনিয়োগ উৎস হিসেবে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করেছে। ২০২৩ সাল থেকে তাদের অবস্থান ধারাবাহিকভাবে উন্নত হচ্ছে। এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশ দক্ষিণ কোরিয়ান বিনিয়োগকারীদের কাছে ক্রমেই আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে।

রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মাঝেও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

২০২৪ সালের বিক্ষোভ ও অস্থিরতার পর বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন এবং শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরুতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মাঝে দ্বিধা সৃষ্টি করলেও, ইউনূস সরকারের সংস্কার প্রতিশ্রুতি নতুন করে আগ্রহ জাগিয়েছে। এর প্রমাণ হলো—২০২৫ সালের বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিটে প্রায় ২,৫০০ অংশগ্রহণকারীর উপস্থিতি।

বাংলাদেশ যদি বর্তমান সংস্কারমুখী ধারা ধরে রাখতে পারে, তবে এটি বিদেশি পুঁজির জন্য বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হবে। কৌশলগত অবস্থান, তরুণ জনসংখ্যা এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কারণে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা ধরে রেখেছে, বিশেষ করে প্রযুক্তি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও অবকাঠামো খাতে।

বাংলাদেশের উদীয়মান খাতে দক্ষিণ কোরিয়ান বিনিয়োগ

দক্ষিণ কোরিয়ান বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে উৎপাদন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি করেছে। সেই সঙ্গে সেমিকন্ডাক্টর ও ডিজিটাল ইলেকট্রনিকসের মতো নতুন খাতেও তারা পা বাড়াচ্ছে। এই বৈচিত্র্য তাদের কৌশলগত উদ্যোগের অংশ, যার মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের রূপান্তরশীল শিল্পখাত ও ক্রমবর্ধমান ভোক্তা বাজারকে কাজে লাগাতে চায়।

২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে কোরিয়ান বিনিয়োগকারীদের একটি প্রতিনিধি দল, যার মধ্যে এলজির কর্মকর্তারাও ছিলেন, চট্টগ্রামের কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড) পরিদর্শন করে। এটি একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, যেখানে উৎপাদন এবং সবুজ জ্বালানিনির্ভর প্রকল্প চালু আছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, শিল্প গ্রুপ ইয়াংওয়ান টেক্সটাইল ও সৌরজ্বালানি প্রকল্পে বিনিয়োগ নিশ্চিত করেছে। এর এক মাস আগে, ২০২৫ সালের মার্চে হুন্দাই ঘোষণা দেয় যে, তারা ডিএক্স গ্রুপের সঙ্গে মিলে বাংলাদেশের ভোক্তা ইলেকট্রনিকস ও গৃহস্থালি পণ্যের বাজারে প্রবেশ করছে। একইভাবে, স্যামসাং বাংলাদেশের ফেয়ার গ্রুপের সঙ্গে যৌথভাবে মোবাইল ফোন, টেলিভিশন ও এয়ার কন্ডিশনার তৈরি করছে।

এই উদ্যোগগুলো প্রযুক্তি, উৎপাদন ও অন্যান্য খাতে দক্ষিণ কোরিয়ার বাংলাদেশের প্রতি দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি এবং সম্প্রসারিত উপস্থিতিকে নির্দেশ করে।

বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিকে সহযোগী উদ্ভাবনী সহযোগিতা

বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়া উভয় সরকারই বাংলাদেশে স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমকে সমর্থন করে যাচ্ছে। এর একটি উদাহরণ হলো—২০২৩ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে একটি ভার্চুয়াল ডেস্ক চালু করা হয়, যা আইটি-ভিত্তিক আকৃষ্ট করতে সহায়ক। এছাড়া, বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি বিভাগ ও কোরিয়া প্রোডাক্টিভিটি সেন্টারের মধ্যে একটি যৌথ মেন্টরিং কর্মসূচি শুরু হয়েছে, যা বাংলাদেশে স্টার্টআপ বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে।

স্বাস্থ্য খাতসহ অন্যান্য খাতে সরকারি সহযোগিতা এবং দ্বিপাক্ষিক মানদণ্ড নির্ধারণ এই দুই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রতি অঙ্গীকারকে আরো শক্তিশালী করে তুলেছে।

এই ধরনের সহায়ক নীতির ফলেই সীমান্ত অতিক্রমকারী স্টার্টআপগুলো গড়ে উঠছে। এর একটি উদাহরণ হলো— কোরিয়ান-প্রতিষ্ঠিত ফুড-টেক স্টার্টআপ এমএফএম কোরিয়া। যা বাংলাদেশের নারীদের জন্য রিসোর্স রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করছে। অপরদিকে, বাংলাদেশি স্টার্টআপ চারদিকে কোরিয়ান পণ্য বিক্রির একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে, যা দুই দেশের স্টার্টআপ আগ্রহের প্রাকৃতিক সম্প্রসারণকে তুলে ধরে।

শুধু স্টার্টআপ নয়, প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোও এ ধরনের সহযোগিতাকে কাজে লাগাচ্ছে। ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে, বাংলাদেশের আইটি পণ্য পরিবেশক গ্লোবাল ব্র্যান্ড পিএলসি এবং কোরিয়ান ফিনটেক কোম্পানি একটি অংশীদারিত্ব ঘোষণা করে, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্যাংকিং অবকাঠামোকে আধুনিকায়ন করা হবে। এর আগেও দক্ষিণ কোরিয়ান বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ওউরি ব্যাংক বাংলাদেশের ডিজিটাল ওয়ালেট বিকাশ এবং পণ্য পরামর্শ সাইট Bankcomparebd-এর সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলে।

ভবিষ্যতের প্রবৃদ্ধির চাবিকাঠি উন্মোচন

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক রূপান্তর এখন আর শুধু উৎপাদনশীল খাতে সীমাবদ্ধ নয়। ডিজিটাল অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার ইচ্ছা বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার স্টার্টআপ উভয়ের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করছে—ডিজিটাল পেমেন্ট, ই-কমার্স এবং স্মার্ট সিটি অবকাঠামো এর মূল ক্ষেত্র।

এই সহযোগিতার এক উদাহরণ হলো—বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মীরসরাই, যেটি একটি জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (NSEC) হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে স্মার্ট সিটির ওপর ভিত্তি করে। দক্ষিণ কোরিয়া ২০২৮ সালের মধ্যে মীরসরাইকে আধুনিক স্মার্ট শহরে রূপান্তরের পরিকল্পনা করছে। তারা এর মডেল হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ার উলসান এবং চীনের শেনজেনের মতো উপকূলীয় শিল্পনগরীর দিকে তাকিয়ে আছে, যেগুলো অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে।

মীরসরাইয়ের মতো অঞ্চলগুলো স্টার্টআপ এবং বৃহৎ কোম্পানির জন্য বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করছে। এর নিকটবর্তী চট্টগ্রাম বন্দরের সান্নিধ্য এবং বিমানবন্দরের সহজলভ্যতাও একে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ডিজিটাল ইকোসিস্টেমে পরিণত করতে সহায়ক।

এই উদাহরণ প্রমাণ করে যে, শুধু উৎপাদন নয়—বাংলাদেশকে সমানভাবে ডিজিটাল অর্থনীতিকেও কাজে লাগাতে হবে। এজন্য কোরিয়ান স্টার্টআপ এবং প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব অপরিহার্য।

Share