বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নটি সব সময়ই ছিল একটি মৌলিক ও স্পর্শকাতর বিষয়। আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম ১৯৭১ সালে চূড়ান্ত রূপ লাভ করলেও, এর শিকড় আরও গভীরে প্রোথিত। এই ধারাবাহিকতায় এক অনন্য রাজনৈতিক বাঁক ছিল। এজনপদের সার্বভৌমত্ব কোনো হঠাৎ পাওয়া উপহার নয় ।এটি এক দীর্ঘ সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, আন্দোলন ও বিপ্লবের ফসল। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের বিভিন্ন মাইলফলক এই সার্বভৌমত্বের ভিত্তি রচনা করেছে, যার মধ্যে ১৯৪৭ এ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান বিভাগ, ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব উল্লেখযোগ্য।
১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগ আমাদের জন্য ছিল একটি নতুন সূচনা। পাকিস্তানের অংশ হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও, শুরু থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে পূর্ব বাংলার মানুষকে তাদের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে। এই অবিচার ও বৈষম্যের অভিজ্ঞতা থেকেই জন্ম নেয় স্বাধীন সত্তার বীজ।
এই বীজ অঙ্কুরিত হয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে, যখন বাঙালি জাতি মাতৃভাষার অধিকারের জন্য বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” এই দাবির পেছনে ছিল কেবল ভাষার প্রশ্ন নয়, ছিল জাতীয় পরিচয়, মর্যাদা ও আত্মপরিচয়ের দাবি। একুশের শহিদরা আমাদের শিখিয়েছেন সার্বভৌমত্বের প্রথম ধাপ হলো ভাষার স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা।
এর দুই দশক পর, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এই সংগ্রাম পূর্ণতা পায়। লাখো শহিদের রক্ত, মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ আর সাধারণ মানুষের একাত্মতার মাধ্যমে আমরা অর্জন করি একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। এই মহান বিজয় আমাদের জাতীয় ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ অর্জন, যার মূল কথাই ছিল স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার।
তবে স্বাধীনতা অর্জনের পরও চ্যালেঞ্জ থেমে থাকেনি। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, বৈদেশিক নির্ভরতা এবং বিশ্ব রাজনীতির চাপের মধ্যে দিয়ে বারবার আমাদের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটেই ২০২৪ সালের ‘জুলাই বিপ্লব’ এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। তরুণ সমাজ, শিক্ষিত নাগরিক ও সচেতন শ্রেণির অংশগ্রহণে গঠিত এ গণজাগরণ ছিল এক ধরনের গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণ যার লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক স্বচ্ছতা, রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতা এবং বিদেশি আধিপত্যবাদের প্রভাবমুক্ত নীতি প্রণয়ন।
এই বিপ্লব মূলত এক শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের মতপ্রকাশ ও রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটায়। জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ, এবং দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ এই ছিল আন্দোলনের মূল মন্ত্র। এভাবেই ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব আবার আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে যে, “বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব সবার আগে।”
আজকের বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে এক মডেল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বিবাজনের ফলে যদি স্বাধীন চিন্তা, নীতি প্রণয়ন কিংবা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে হস্তক্ষেপ হয়, তবে সেটি হবে আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। তাই রাষ্ট্রের প্রতিটি সিদ্ধান্তে, প্রতিটি চুক্তিতে এবং প্রতিটি আন্দোলনে এই সত্যটি মাথায় রাখতে হবে জাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে সার্বভৌমত্বকে সবার আগে স্থান দিতে হবে।
জুলাই বিপ্লব আমাদের শেখায়, জাতীয় স্বার্থের ক্ষেত্রে আপস করা যায় না। সার্বভৌমত্ব মানে শুধু ভূখণ্ডের অধিকার নয় এটি জাতীয় নীতি প্রণয়নের স্বাধীনতা, বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা, অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। এই বিপ্লব সেই নীতিগত প্রশ্নগুলো সামনে এনেছিল, যদিও রাজনৈতিক বিভাজন ও পরবর্তী অস্থিরতায় তার তাৎপর্য অনেকাংশেই কলংকিত হয়ে যাচ্ছে ।
আজ যখন আমরা উন্নয়ন ও বৈশ্বিক অংশীদারিত্বের পথে এগিয়ে যাচ্ছি, তখন আবার নতুন করে “বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব সবার আগে” এই মূলনীতিকে সামনে আনতে হবে। বৈদেশিক বিনিয়োগ, কূটনৈতিক সম্পর্ক কিংবা সামরিক সহযোগিতা সব কিছুই হতে হবে আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভিত্তিতে।
জুলাই বিপ্লব, তার ত্যাগ ও বার্তা, আমাদের মনে করিয়ে দেয় দেশের সর্বোচ্চ স্বার্থে কখনো কখনো কঠিন সিদ্ধান্ত ও বলিষ্ঠ অবস্থান নেওয়া জরুরি হয়ে পড়ে। সেই চেতনা থেকেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। সার্বভৌমত্ব কেবল সংবিধানের এক শব্দ নয় এটি একটি জাতির আত্মমর্যাদা ও সম্মানের প্রশ্ন। এই চেতনা অন্তরে ধারণ করেই গড়ে তুলতে হবে আগামীর বাংলাদেশ।আমাদের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আমরা কখনো পরাজিত হইনি যখন ঐক্যবদ্ধ থেকেছি, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ থেকেছি। তাই ভবিষ্যতের পথ চলায়, অতীতের আলোকেই আজকের সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বই আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
~কাওসার আহমেদ