ডেস্ক রিপোর্ট:
বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার ভবেশ চন্দ্র রায় নামে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তিকে অপহরণ ও হত্যা নিয়ে একটি মনগড়া ও মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে। সংবাদটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা হিসেবে ব্যবহার করে। এ সংবাদ প্রকাশের পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা তৈরি হয়।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের ‘ত্রৈমাসিক (এপ্রিল-জুন) মানবাধিকার পরিস্থিতি’ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। গত বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি। অধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানবাধিকার কর্মীদের পাঠানো প্রতিবেদন এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে।
সম্প্রতি অধিকারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, মানবাধিকার, সাংবাদিক নির্যাতন, নারীদের ওপর সহিংসতা, যৌন হয়রানির চিত্র তুলে ধরা হয়। রিপোর্টে ভারতের বিএসএফের সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা, অবৈধ পুশ ইন সর্বোপরি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর বিষয়ে তথ্য তুলে ধরা হয়। অধিকার বলছে, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা ও নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে। অন্যদিকে সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা ও অন্যান্য মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশে অবৈধভাবে ঠেলে পাঠিয়ে দিচ্ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
বিএসএফের হত্যাকাণ্ড
এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত বিএসএফের গুলিতে ৯ বাংলাদেশি নিহত এবং পাঁচজন আহত হয়েছেন। নিহত ৯ জনের মধ্যে সাতজনকে গুলি করে হত্যা ও দুজনকে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে। আহত পাঁচজনের সবাইকে গুলি করে আহত করা হয়েছে।
বাংলাদশের বিরুদ্ধে ভারতের মিথ্যা প্রোপাগান্ডা
হাসিনা সরকারের পতন হওয়ার পর থেকেই ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে এবং ভারতীয় বেশকিছু সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশ সম্পর্কে মিথ্যা ও মনগড়া সংবাদ পরিবেশন করছে। যদিও এসব বিষয় অধিকাংশই ফ্যাক্ট চেকিংয়ের মাধ্যমে মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। আলজাজিরা, এএফপি ফ্যাক্ট চেক, নিউইয়র্ক টাইমস ও বিবিসি Ñএ ধরনের মিথ্যা প্রচারণার প্রমাণ পেয়েছে।
বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার ভবেশ চন্দ্র রায় নামে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তিকে অপহরণ ও হত্যা নিয়ে একটি মনগড়া ও মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে। এ মিথ্যা সংবাদটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা হিসেবে ব্যবহার করে। এ সংবাদ প্রকাশের পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মধ্যে একধরনের উত্তেজনা তৈরি হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভবেশ চন্দ্র রায় অপহরণ ও হত্যার শিকার হয়েছেন বলে বিবৃতি দেয়। পরবর্তী সময়ে সংবাদটি অসত্য প্রমাণিত হওয়ায় দ্য ডেইলি স্টার ভুল তথ্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে প্রতিবেদনটি প্রত্যাহার করে নেয়।
অবৈধ পুশ ইন
ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশে তার স্বার্থ বজায় রাখতে সরকারকে চাপে রাখার জন্য আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করে উসকানিমূলকভাবে গত ৭ মে থেকে দেশটিতে অবস্থানকারী বাংলাদেশি, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং ভারতীয় মুসলিম নাগরিকদের জোর করে, এমনকি রাতের আঁধারে বাংলাদেশে পুশ ইন (ঠেলে পাঠানো) করেছে। যাদের পাঠানো হচ্ছে, তাদের অধিকাংশ ব্যক্তিকেই অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে শূন্যরেখা অতিক্রমে বাধ্য করা হয়েছে। এমনকি তাদের মালামাল ও নগদ অর্থ ছিনিয়ে নিয়েছে বিএসএফ সদস্যরা। গত ২২ মে খাগড়াছড়ির রামগড় সীমান্ত দিয়ে মোহাম্মদ ওমেদ আলীসহ তার পরিবারের পাঁচজন সদস্য বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। ভারতের হরিয়ানা থেকে গভীর রাতে তুলে এনে ত্রিপুরা নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। এরপর বিএসএফ সদস্যরা তাদের হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়। সৌভাগ্যবশত এ পরিবারের সদস্যরা প্রাণে বেঁচে যান এবং ফেনী নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করলে বিজিবি তাদের জিম্মায় নেয়। গত ২৭ মে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে ১৪ জনকে পুশ ইন করেন বিএসএফ সদস্যরা। পুশ ইন হওয়াদের মধ্যে খায়রুল ইসলাম নামে ভারতের আসাম রাজ্যের একজন স্কুল শিক্ষকও ছিলেন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও অধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সীমান্ত এলাকার মানবাধিকারকর্মীদের তথ্য অনুযায়ী, ৩০ জুন পর্যন্ত নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ এক হাজার ৭৮৩ জনকে জোর করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে।
বাংলাদেশের ভূমি দখল করেছে ভারত
ভারত নিজেদের স্বার্থে বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী হাসিনা সরকারকে নিরঙ্কুশ সমর্থন জানিয়ে সেই আমলে তাদের ফায়দা হাসিল করে নিয়েছিল। পঞ্চগড় জেলার সদর, তেঁতুলিয়া ও বোদা উপজেলার বিভিন্ন সীমান্তে ৭৩০ একরেরও বেশী অমীমাংসিত জমি বাংলাদেশের নামে দলিলপত্র থাকলেও ভারত দখল করে নেয়। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের জমি দখল শুরু করে। সর্বশেষ ২০১৫ সালে সম্পূর্ণ জমি ভারত বিএসএফের মাধ্যমে দখল করে নেয়।
আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল
তিন মাসে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের চেষ্টা, দিনমজুরের জমি দখল, সড়ক ও জনপথের জায়গা দখল করে ভবন নির্মাণ, বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা ও অপহরণ, সাধারণ নাগরিকদের ওপর নিপীড়ন, বিএনপি নেতার কবজি কর্তন, পুলিশের কাছ থেকে দলীয় কর্মীকে ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ২ এপ্রিল নোয়াখালীর সদর উপজেলার মাইজদীতে জাকির হোসেন আলো নামে এক বিএনপি নেতাকে কুপিয়ে জখম করে যুবলীগ নেতা পিয়াসের নেতৃত্বে একদল দুর্বৃত্ত। বরগুনার আমতলীতে চাঁদা না দেয়ায় আওয়ামী লীগ নেতা ইসরাফিল মোল্লা ব্যবসায়ী ছিদ্দিক খানের বাড়িতে ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা করে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। ৫ এপ্রিল শরীয়তপুরের জাজিরায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে ব্যাপক বোমাবাজির ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে নারীসহ ১৫ জন আহত হন। ২৩ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে জামায়াতে ইসলামী একটি মিছিল বের করলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে তাদের ওপর হামলা চালালে জামায়াত নেতা জসিম উদ্দিন গুরুতর আহত হন।
চলতি বছরের এপ্রিল-জুন পর্যন্ত সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় কমপক্ষে ৭২ জন নিহত ও ১৬৭৭ জন আহত হয়েছেন। এই তিন মাসে বিএনপির ১০৫টি ও আওয়ামী লীগের ৪টি অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ১৯ জন নিহত ও ৯৭৩ জন আহত এবং আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ২ জন নিহত ও ২৪ জন আহত হয়েছেন। তিন মাসে ২০৮ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ৩ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৪ জন নারী ও মেয়ে শিশু। এ ছাড়া নারী ও শিশুদের ওপর সংঘটিত যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৩ জন পুরুষ নিহত ও ৭ জন পুরুষ আহত হয়েছেন। গত তিন মাসে মোট ১৯ জন নারী যৌতুক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ১১ জন নারীকে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে।
২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে জুন এই তিন মাসে ৮ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ৫ জন পুলিশ, ১ জন র্যাব, ১ জন কোস্টগার্ড ও ১ জন যৌথ বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এদের মধ্যে ২ জন নির্যাতনে, ৫ জন গুলিতে এবং ১ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এপ্রিল থেকে জুন এই তিন মাসে ২২ ব্যক্তি কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন। এদের মধ্যে ২১ জন অসুস্থতার কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন ও ১ জন আত্মহত্যা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই সময়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় ৩০ জন সাংবাদিক আহত, ১৬ জন লাঞ্ছিত ও ১১ জন হুমকির শিকার হয়েছেন।
অধিকার বলছে, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অন্ততপক্ষে ১ হাজার ৪০০ মানুষকে হত্যা করার পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয় কর্তৃত্ববাদী শাসক শেখ হাসিনার সরকার। এরপর অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে গণতান্ত্রিক নীতি প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান পুনঃস্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেয় ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু রাজনৈতিক সহিংসতা ও দুর্বৃত্তয়ান এই প্রতিশ্রুতির অন্তরায় হয়ে উঠেছে।
গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ থাকার কারণে র্যাবের অবলুপ্তির জন্য মানবাধিকার কর্মীদের পক্ষ থেকে তোলা দাবির বিষয়ে সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে অধিকার।
গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা হাসিনা সরকারের পতনের পর পালিয়ে যায়, তাদেরও বিচারের আওতায় আনার ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই বলে মনে করছে সংস্থাটি।