দাবা’র ছায়ামঞ্চ

দাবা’র ছায়ামঞ্চ

আনুশেহ্ আনাদিল

অনুবাদঃ মোহাম্মদ মাহবুব হোসাইন 

বাংলাদেশের ৫ জুলাইয়ের বিপ্লবকে একক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখা যায় না।এটি যেমন ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছাত্রদের একটি প্রকৃত বিদ্রোহ, তেমনি এটি ছিল বৈশ্বিক রাজনীতির জটিল জালে জড়িয়ে থাকা একটি মুহূর্ত। কেউ কেউ বলছেন ইসলামী দলগুলো এতে ভূমিকা রেখেছে, কিন্তু বাস্তবতা আরও জটিল; এখানে অনেকগুলো শক্তি একসঙ্গে কাজ করেছে।

একই সময়ে, বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান দ্বন্দ্ব এবং BRICS জোটের বিশ্ব অর্থনীতির পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা। এই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বের গোলকধাঁধায় সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো সচেতনতা, গোপন শক্তির প্রভাব, মিত্রতার পরিবর্তন, এবং এই প্রশ্ন করা যে আমরা, বৈশ্বিক দক্ষিণের অংশ হিসেবে, আসলে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি।

কারণ, দক্ষিণ যদি উঠে দাঁড়াতে চায়, তাহলে তাকে স্পষ্টতা ও আত্মচেতনার সঙ্গে দাঁড়াতে হবে; অন্য কারও খেলার গুটি না হয়ে।

এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে শেখ হাসিনার শাসনামল ছিল ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং পদ্ধতিগতভাবে বাংলাদেশের সম্পদ নিঃশেষ করার কাজ করেছে। তবে এটাও সত্য যে চীন ও ভারতের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তাঁকে অনেক বড় ধরনের সমালোচনা থেকে রক্ষা করেছে। বিশেষত বামপন্থী মহলের অনেকাংশই তাঁর শাসনামলে নীরব ছিল।

তবে আজকের পরিস্থিতি স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি দাবি করে। আমাদের স্বীকার করতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব অস্বীকারযোগ্য নয়, এবং তাদের হস্তক্ষেপ প্রায়ই দেশগুলিকে আরও চরমপন্থী ও অস্থির করে তুলেছে।আফগানিস্তান, ইরাক এবং মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ অঞ্চল তার জ্বলন্ত উদাহরণ। যদি আমরা বৈশ্বিক রাজনীতির বৃহত্তর প্রবাহকে বুঝতে ব্যর্থ হই, তাহলে বাংলাদেশও চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের চলমান ক্ষমতার দ্বন্দ্বে আরেকটি রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

আমরা বর্তমানে দাঁড়িয়ে আছি এক গভীর বৈশ্বিক পরিবর্তনের প্রান্তে, যেখানে বিশ্বব্যাপী রাজনীতি দৃঢ়ভাবে ডানের দিকে ঝুঁকছে। কেন এমন হচ্ছে তা বোঝার জন্য আমাদের বামপন্থার ব্যর্থতাগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করতে হবে। এক সময় যা ছিল ন্যায়ের ও প্রান্তিক মানুষের অধিকারের প্রতীক, সেই বাম আজ অনেকাংশে পুঁজিবাদী ও কর্পোরেট নির্ভর হয়ে পড়েছে; যেখানে রাজনীতিকরা ধনীদের অর্থায়নে পরিচালিত এবং কর্পোরেট স্বার্থে বাঁধা। এর ফলে, তাদের কর্মসূচি সাধারণ মানুষের বাস্তবতা ও সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

অনিশ্চয়তা ও হতাশার সময়ে, সাধারণ মানুষ; যারা গভীরভাবে ধর্মপ্রাণ।তাঁরা ঈমানের দিকে ফিরে যান এবং আল্লাহর কাছে আশ্রয় খোঁজেন। এই আত্মিক আকাঙ্ক্ষাই বহু সমাজকে ডানপন্থী রাজনীতির দিকে আকৃষ্ট করেছে, কারণ ডানপন্থা প্রায়ই এই অর্থবোধের খোঁজের প্রতি সরাসরি সাড়া দেয়।

কিন্তু “বাম” ও “ডান” এই রাজনীতির লেবেলগুলোর বাইরেও, মানবজাতি প্রকৃতপক্ষে যেটা খুঁজছে তা হলো: ন্যায়বিচার, মর্যাদা, এবং ধনী-গরিবের মধ্যে দিন দিন বাড়তে থাকা বৈষম্যের অবসান। মানুষ এমন নেতৃত্ব কামনা করে, যারা পৃথিবীকে একটি বাজার নয়, বরং করুণা, ন্যায্যতা ও প্রকৃতির প্রতি যত্নশীল দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে; যেখানে মানুষকে পণ্যে পরিণত করা হয় না।

এখন সময় এমন নেতাদের, যারা সত্যিকারের জনগণের সেবক, যারা দুর্বলদের সম্মান রক্ষা করে এবং পরিবেশকে রক্ষা করে, যাঁরা মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারেন, জীবনের গভীরতাকে অর্থ দিতে পারেন এবং শোষণের পথ থেকে মানবিক ও ভারসাম্যপূর্ণ ভবিষ্যতের দিকে সমাজকে এগিয়ে নিতে পারেন।

বাংলাদেশ একটি নবীন জাতি, জন্ম ১৯৭১ সালে। এরপর কয়েক দশক পেরিয়ে গেলেও আমাদের অন্যতম বড় সংগ্রাম ছিল পরিচয়ের প্রশ্ন। যারাই রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে, তারা প্রত্যেকেই একটি নির্দিষ্ট পরিচয় চাপিয়ে দিতে চেয়েছে।কিন্তু কেউই এমন কোনো দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করতে পারেনি যা আমাদের সবাইকে ধারণ করতে পারে। বরং আমরা দুটি চরম মেরুর মাঝে আটকে গেছি: আমরা আগে বাঙালি, না আগে মুসলমান?

এই দুই পরিচয়ের মধ্যে সমন্বয় করতে না পারার ফলে সমাজে বিভক্তি ও দ্বন্দ্ব বেড়েছে।

আসলে, পরিচয়কে একটি মাত্র বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায় না। একটি জাতি একক কোনো সংস্কৃতি নয়; বরং বহু সংস্কৃতির সমন্বয়। বাংলাদেশ ভাষা, ধর্ম ও ঐতিহ্যের এক বৈচিত্র্যময় মোজাইক। কিন্তু এই বৈচিত্র্যকে আলিঙ্গন করার বদলে আমাদের রাজনীতি দুই চরমপন্থায় আটকে গেছে। একদিকে কঠোর ধর্মীয় রক্ষণশীলতা, অপরদিকে অতিরঞ্জিত সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ। এই দুই মেরুর মাঝে মিলনের কোনো জায়গা আর অবশিষ্ট নেই।

এই বিভক্তি নিরাময় করতে হলে আমাদের শিখতে হবে, নিজেকে শুধুই একটিতে নয়, বরং একাধিক পরিচয়ে দেখা। আমাদের বৈচিত্র্যকে শক্তি হিসেবে গ্রহণ করাই হলো একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় পরিচয়ের পথে এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ। কেবল তখনই আমরা বুঝতে পারবো; আমরা শুধু বাঙালি বা মুসলমান নই, আমরা বাংলাদেশি।

এই যুগে আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক ছায়াঘেরা দাবার বোর্ডের উপর, যেখানে বাইরের শক্তি ও বিদেশি বর্ণনাগুলো আমাদের পরিচয় নির্ধারণ করতে চায়। কিন্তু নতুন প্রজন্ম অন্যের খেলায় নিছক একেকটা গুটি হয়ে থাকতে রাজি নয়। 

তারা মেরুকরণকে প্রত্যাখ্যান করছে। বাম না ডান, ঐতিহ্য না আধুনিকতা, জাতীয়তাবাদ না বিশ্বায়ন এই সব কৃত্রিম বিভাজনের বাইরে তারা নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ করছে একটি মধ্যপন্থায়। তারা নিজেদের ‘মধ্যপন্থী’ বলছে কোনো দুর্বলতা থেকে নয়, বরং একটি বিশ্বাস থেকে: যে বৈরিতার বদলে সহাবস্থান, অন্ধ আনুগত্যের বদলে ভারসাম্য প্রয়োজন।

তাদের চাওয়া কোনো ফাঁপা পরিচয় নয়, নয় বিভক্ত দেশপ্রেম। তাদের আকাঙ্ক্ষা মানুষের মৌলিক মর্যাদার উপর দাঁড়ানো এক দেশ: একটি এমন জায়গা, যেখানে মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারে।

আমাদের দেশ একক কোনো ইসলামি ব্যাখ্যা বা একমাত্র সংস্কৃতির দ্বারা গঠিত নয়, বরং বহু সংস্কৃতি, ভাষা ও বিশ্বাসের বুননে গঠিত এক অভিন্ন আবাস। আমাদের কাজ এই ভিন্নতাগুলোকে মুছে ফেলা নয়, কিংবা অস্ত্র বানানোও নয়; বরং শিখে নেওয়া, কীভাবে পাশাপাশি সহাবস্থান করা যায়।

এই প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি হলো বিভাজন নয়, সহাবস্থান; অন্ধকার নয়, আলো।

লেখকঃ সঙ্গীত শিল্পী ও সমাজকর্মী।

Share