হাসপাতালে আহতদের ভিড়, মেট্রোরেল নিয়ে হাসিনার মায়াকান্না

আবু সুফিয়ান:

নির্বিচারে গুলি, গণগ্রেপ্তার এবং হাসপাতালগুলোতে আহত তরুণদের ভিড়ে ২০২৪ সালের ২৫ জুলাই ঢাকার রাজপথে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে পথচারী-বৃদ্ধ কেউই শেখ হাসিনা সরকারের নির্মমতা থেকে রক্ষা পাননি। এদিন রাজধানীসহ সারা দেশে দিনভর থেমে থেমে চলেছে গুলিবর্ষণ। হাসপাতালের বারান্দা কেঁপে উঠছিল গুলিবিদ্ধদের আর্তনাদে।

সেদিনের গণগ্রেপ্তারও ছিল ভয়াবহ। স্কুলের ইউনিফর্ম পরে আসা কিশোরদেরও টেনে তোলা হয় পুলিশের প্রিজন ভ্যানে। পরিচয় না জেনে মামলা ছাড়াই তুলে নেওয়া হয় শত শত মানুষকে। ঢাকা মেডিকেলসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব হাসপাতালে ছিল গুলিবিদ্ধ মানুষের ভিড় আর আর্তনাদ। এ যেন শুধুই একটি দমন-পীড়নের দিন নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আরেকটি নির্মম গণহত্যার দলিল।

উত্তরার হাসপাতালগুলোয় আহতদের ভিড়

২০২৪ সালের ১৮ জুলাই থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত ঢাকার উত্তরা এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ঘটে যাওয়া সংঘর্ষে অসংখ্য শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়। এ সময়কালে উত্তরার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে অন্তত ৮৬৭ আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসা দেওয়া হয় এবং ২৯টি মৃতদেহ আনা হয়। এ সময় হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা চরম চাপের মধ্যে পড়েন।

বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ১৮ থেকে ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে ২৬৫ জন আহত ব্যক্তি চিকিৎসাসেবা নেন। সেখানে আটটি মৃতদেহ আনা হয়। সৈয়দ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৫ জুলাই পর্যন্ত ১৭৫ জন আহত এবং দুটি মৃতদেহ আসে; তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃতদেহ গ্রহণ না করায় তা ফেরত পাঠানো হয়। উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৬৩ জন আহত এবং ১১টি মৃতদেহ আনা হয়। রামপুরার ফরাজী হাসপাতালেও হতাহতের এমন চিত্র দেখা যায়।

চিকিৎসার চাপ ও রোগীর ভিড়ে হাসপাতালগুলো যেন ভেঙে পড়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। স্বাস্থ্যকর্মীরা অভিযোগ করেছিলেন, রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে হুমকি আর অতিরিক্ত চাপের মুখে পড়তে হয়েছিল তাদের। আহত অনেক রোগী চিকিৎসা সম্পন্ন না করে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান; কারণ তারা আশঙ্কা করতেন হাসপাতালে থাকলে হয়রানির শিকার হতে পারেন।

মেট্রোরেলের জন্য হাসিনার মায়াকান্না

শেখ হাসিনার নির্দেশে শিক্ষার্থীদের ওপর ইতিহাসের নির্মম হত্যাযজ্ঞের মাঝেই মেট্রোরেলে রহস্যজনক আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছিল। ভিডিও ফুটেজে যাদের দেখা গিয়েছিল, তাদের শিক্ষার্থী বলে মনে হয়নি। রহস্যজনক সেই নাশকতার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এর দায় শিক্ষার্থীদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করেন। ২৫ জুলাই সকালে মিরপুর-১০ নম্বর মেট্রো স্টেশন পরিদর্শন করেন তিনি। সেখানে তার কান্নার ভিডিওটি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘নাটক কম করো পিও’ বলে প্রতিবাদ করেন নেটিজেনরা। রাজধানীর বিভিন্ন দেয়ালেও গ্রাফিতিতে ফুটে ওঠে এই বাক্য।

সেদিন শেখ হাসিনা দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত ধ্বংসযজ্ঞের জন্য দোষীদের বিচার দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘দেশের জনগণকে তাদের (তার ভাষায় তাণ্ডবকারীদের) বিচার করতে হবে।’

শতাধিক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা

কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের অভিযোগে ২৫ জুলাই পর্যন্ত পাঁচ মামলায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থীকে আসামি করা হয়। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫ শিক্ষার্থীর নাম উল্লেখ করে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়। এছাড়া রূপনগর থানায় এক হাজার ৫০০ অজ্ঞাতনামাকে অভিযুক্ত করে দুটি মামলা করা হয়।

শেরেবাংলা নগর থানায় রাস্তা অবরোধ ও পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপের অভিযোগে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। রাজশাহীতে ছাত্রলীগের কক্ষে হামলা ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে ১৫ শিক্ষার্থীকে আসামি করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অজ্ঞাতনামা’ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানায় মামলা হয়। রূপনগর থানায় দুটি পৃথক মামলায় অজ্ঞাতনামা এক হাজার থেকে ১৫০০ জনকে আসামি করা হয়।

এর আগে শাহবাগ থানায় ১২ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত ১১টি মামলা হয়, যার বেশিরভাগ মামলাতেই ‘অজ্ঞাত আন্দোলনকারী’দের আসামি রয়েছে। তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তবে সহিংসতায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

অন্যদিকে আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম অভিযোগ করেন, এসব মামলা শিক্ষার্থীদের দমনের উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগ বিতাড়িত

২৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সহিংসতার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলে তাদের ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করে। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা লাঠি-রড ও দেশি অস্ত্র ব্যবহার করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর বর্বর হামলা চালিয়ে তাদের আহত করে। তবে শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী সেখান থেকে সরে যায়।

শিক্ষার্থীরা শেষ পর্যন্ত ক্যাম্পাস ও আবাসিক হলের নিয়ন্ত্রণ ছাত্রলীগের কাছ থেকে নিজেদের হাতে নেয়। এ সময় অনেক ছাত্রলীগকর্মী ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যায়।

সার্বিকভাবে ২৫ জুলাই কোটা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে পরিগণিত হয়, যেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সংগঠিত হয়ে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সহিংসতা প্রতিরোধ করে।

Share