ইসরাইলের সঙ্গে জোটে মার্কিন আধিপত্যে ধস, উত্থান চীনের

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

একবিংশ শতাব্দীর ভূ-রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

তিন দশক ধরে যখন একমেরু প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক আধিপত্য ক্রমশ তুঙ্গে, তখন অর্থনৈতিক, সামরিক এবং কূটনৈতিক শক্তি হিসেবে চীনের উত্থান বিশ্ব ব্যবস্থায় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।

বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র আঞ্চলিক লড়াই, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে, যাতে কোনো কৌশলগত সুফল আসছে না বরং প্রভাব কমে যাওয়ার ধারণাকে আরো গভীর করছে।

ইসরাইলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে অটল সমর্থন মার্কিন শক্তি এবং ইহুদিবাদী উদ্যোগ উভয়ের বৈধতা সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী ধারণা পাল্টাতে শুরু করেছে।

সেই সঙ্গে ঘটনাগুলো মার্কিন আধিপত্যে ধস এবং একটি নতুন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার উত্থানকে চিহ্নিত করে।

কৌশলগত ধৈর্য

স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির পর থেকে, চীন নীতিগতভাবে ধৈর্য ধরে এগিয়ে যাওয়ার একটি দীর্ঘমেয়াদী কৌশল অনুসরণ করে গেছে। এটা এক বহুমাত্রিক পদ্ধতি যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামরিক আধুনিকীকরণ এবং বহুপাক্ষিক সম্পৃক্ততার ওপর জোর দেয়।

‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ হলো এই কৌশলের মূল উপাদান। এর লক্ষ্য ইউরেশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকা জুড়ে অবকাঠামো, বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ চুক্তির একটি জালে তৈরি করা।

এই উদ্যোগ চীনকে কেবল গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ সুরক্ষিত করতে এবং বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য রুটগুলোকে প্রভাবিত করতেই সাহায্য করেছে না, বরং পশ্চিমা-অধ্যুষিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে এড়িয়ে তার উন্নয়ন মডেল ছড়িয়ে দিতেও সাহায্য করেছে।

চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিস্ময়কর। এই প্রবৃদ্ধি সমানভাবে সামরিক আধুনিকায়নে অর্থায়ন করেছে। যদিও চীন এখনো যুক্তরাষ্ট্রকে প্রভাবশালী বৈশ্বিক সামরিক শক্তি হিসেবে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি, তবুও তারা আঞ্চলিকভাবে, বিশেষ করে দক্ষিণ ও পূর্ব চীন সাগরে, ক্রমবর্ধমানভাবে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছে।

চীন তার সীমান্তের আশপাশে মার্কিন হস্তক্ষেপ রোধ করতে চায়। পূর্ব এশিয়ায় প্রভাবশালী শক্তি হয়ে উঠার পথে এটি একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ।

ব্রিকস, সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা এবং নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের মতো আর্থিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে, চীন এবং তার অংশীদাররা ক্রমাগত একটি বহুমেরু বিশ্ব ব্যবস্থা তৈরি করছে। যা মার্কিন নেতৃত্বাধীন উদার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জ করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের মহাকৌশল

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। ইউরোপ এবং পূর্ব এশিয়ায় সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের দুর্বল করতে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল।

ইউরোপে, তারা ১৯৯১ সালে ন্যাটোকে ১৬ সদস্য থেকে পূর্ব দিকে ৩২ সদস্যে সম্প্রসারিত করে, রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখার বা রাজনৈতিকভাবে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করে। সোভিয়েত-পরবর্তী রাষ্ট্রগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার মতো পশ্চিমাপন্থী আন্দোলনের প্রতি সমর্থন মস্কোর প্রভাবকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল।

ন্যাটোর সম্প্রসারণকে অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে দেখে থাকে রাশিয়া। যার পরিণতি হয় ২০২২ সালে ইউক্রেনে আক্রমণ।

২০০১ সালে চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগ দেয় এবং যুক্তরাষ্ট্র ও সারাবিশ্বের বিনিয়োগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। কিন্তু নব্য উদারনৈতিক গণতন্ত্রে রূপান্তরিত হওয়ার পরিবর্তে, চীন তার কর্তৃত্ববাদী শাসন কাঠামো বজায় রেখেছে এবং অসাধারণ অর্থনৈতিক সম্পদ এবং প্রযুক্তিগত শক্তি অর্জন করেছে।

সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের তৃতীয় স্তম্ভ

মার্কিন আধিপত্যের তৃতীয় স্তম্ভ পারস্য উপসাগর এবং বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত। তেল সমৃদ্ধ এই অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন কৌশলগত পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে- কেবল জ্বালানি প্রবেশাধিকারের জন্যই নয়, বরং মার্কিন ডলারের প্রাধান্য বজায় রাখার জন্যও।

৯/১১-এর পর, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি উচ্চাভিলাষী এবং উগ্রবাদী মোড় নেয়। গণতন্ত্রীকরণ, শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন এবং জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে তারা আফগানিস্তান এবং ইরাক আক্রমণ করে।

তবে বিপুল সামরিক ব্যয় এবং হাজার হাজার সেনার ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও ইরাক এবং আফগানিস্তান উভয় স্থানেই যুক্তরাষ্ট্র পরাজিত হয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যকে পুনর্গঠনের স্বপ্ন বিশৃঙ্খলা, বিদ্রোহ এবং ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

কৌশলগত দায়

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতি সবসময়ে ইসরাইলের সঙ্গে তার সম্পর্কের চারপাশে আবর্তিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে কৌশলগত মিত্র হিসেবে দেখে আসছে। ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নিজেকে বিশ্ব বাণিজ্য ও অবকাঠামোর একটি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলে চায়।

তবে এই উপেক্ষা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণকে উস্কে দিতে সাহায্য করে। এই হামলা ইসরাইলের অজেয় মনোভাবকে ধূলায় মিশিয়ে দেয়।

ঐতিহাসিক ভাঙন

বিশ্বে প্রযুক্তিগতভাবে সবচেয়ে উন্নত সেনাবাহিনী এবং বিশাল গোয়েন্দা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও, ইহুদিবাদী সরকার হামলা সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞ ছিল। এই অভিযান ইসরাইলের প্রতিরোধ কৌশল, সামরিক মতবাদ এবং অভ্যন্তরীণ সংহতির ব্যর্থতা প্রকাশ করে দেয়।

প্রতিক্রিয়ায়, গাজায় ইসরাইল আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক গণহত্যা শুরু করে। হামাসকে নির্মূলে এর নেতাদের নির্বাসিত করা বা এর সামরিক কাঠামো ধ্বংস করার মাধ্যমে পূর্ণ বিজয় অর্জনে ইসরাইলের সামরিক লক্ষ্য এখনো অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।

আন্তর্জাতিকভাবে ইসরাইলের হামলার শিকার হওয়া বা আত্মরক্ষার অধিকারের বয়ান গুরুত্ব হারিয়েছে।

জনমত নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে, লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করতে।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালত এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো অভূতপূর্ব পদক্ষেপ নিয়েছে।

বয়কট, বিচ্ছিন্নতা এবং নিষেধাজ্ঞার আহ্বান বাড়ছে। অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে, পর্যটন ভেঙে পড়েছে। ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।

ভঙ্গুর জোট

ওয়াশিংটন এবং তেলআবিব কৌশলগত লক্ষ্য ভাগাভাগি করে নেয়। ফিলিস্তিনি প্রতিরোধকে পরাজিত করা, ইরানকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং আঞ্চলিক প্রাধান্য বজায় রাখা তাদের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য।

ইসরাইল সামরিকভাবে প্রতিরোধকে দমন করতে ব্যর্থ হওয়ায়, ওয়াশিংটন আঞ্চলিক শৃঙ্খলা রক্ষা করে যুদ্ধ শেষ করতে আগ্রহী।

নতুন ব্যবস্থা

ট্রাম্পের ‘মেক অ্যামেরিকা গ্রেট এগেইন’ আন্দোলনের উত্থান, মার্কিন কৌশলগত বিশ্বাসযোগ্যতায় ধস, সমকক্ষ প্রতিযোগী হিসেবে চীনের উত্থান এবং ইসরাইলি প্রতিরোধের আঞ্চলিক অবসান এগুলো একসঙ্গে বিশ্বব্যাপী শক্তির ঐতিহাসিক পুনর্বিন্যাসের দ্বারপ্রান্ত তৈরি করেছে। আরব ও মুসলিম বিশ্বের জন্য, এই মুহূর্তটি একটি জরুরি প্রয়োজনীয়তা উপস্থাপন করে। আর তাহলো বিদেশি আধিপত্য এবং ইহুদিবাদী আধিপত্যবাদী নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হওয়া। গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং জাতিগত নির্মূলের অপ্রতিরোধ্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ইসরাইলকে তার অপরাধের জন্য জবাবদিহি করতে অনিচ্ছুক বা অক্ষম বলে প্রমাণিত হয়েছে।

এটি এমন একটি কাঠামোগত ব্যবস্থাকে উন্মোচিত করে যেখানে ‘আইন নয়, কেবল ক্ষমতাই বৈধতা নির্ধারণ করে।’ আরব ও মুসলিম জনগণের মৌলিক স্বার্থ এই ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলার মধ্যে নিহিত।

কেবলমাত্র এই আধিপত্যবাদী কাঠামোর মুখোমুখি হয়ে এবং ভেঙে ফেলার মাধ্যমেই এই অঞ্চলে একটি প্রকৃত নবজাগরণ শুরু হতে পারে। এই সংগ্রামকে অন্য সব কিছুর চেয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে; অস্পষ্ট আদর্শ হিসেবে নয়, বরং একটি কৌশলগত প্রয়োজনীয়তা হিসেবে।

যুক্তরাষ্ট্রের অভিপত্য রাতারাতি ফ্যাকাশে নাও হতে পারে, তবে এটি স্পষ্টতই চলছে।

ইসরাইলি চরমপন্থা আরেকটি আরব বসন্ত ২.০ এর ঝুঁকি তৈরি করছে। যা কেবল দেশীয় স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধেই নয়; বরং ইহুদিবাদী বর্ণবাদী কাঠামো এবং তাদের টিকিয়ে রাখা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা ভেঙে ফেলার দিকেও পরিচালিত হবে।

এই সংকটময় মুহূর্তে, আরব ও মুসলিম বিশ্বের জনগণকে একটি নতুন পথ নির্ধারণ করতে হবে; যা তাদের নিজস্ব অবস্থান প্রতিষ্ঠা করবে, সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার করবে এবং একটি ন্যায়সঙ্গত ও বহুমেরু বিশ্ব ব্যবস্থায় তাদের স্থান পুনর্নির্ধারণ করবে।

(মিডল ইস্ট আই-এ প্রকাশিত সামি আল-আরিয়ানের প্রবন্ধ, অনুবাদ করেছেন রুবিনা আক্তার)

Share