অর্থনীতি ডেস্ক:
দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ আরো বেড়েছে। চলতি বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের চার ভাগের এক ভাগের বেশি ইতোমধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে। ব্যাংকগুলোর প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে জুন প্রান্তিকের খেলাপি ঋণের এ হিসাব প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীদের মতে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অনিয়মের মাধ্যমে তাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের যেসব ঋণ দেওয়া হয়েছিল তা এখন খেলাপি হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি সম্প্রতি খেলাপি ঋণের নিয়মে বড় পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগে যেখানে একটি ঋণ ৯ মাস অনাদায়ী থাকলে খেলাপি হতো, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে সেটি তিন মাস অনাদায়ী থাকলে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নিয়ম পরিবর্তনের কারণে ব্যাংকের টাকা নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠান যেমন খেলাপির তালিকায় যুক্ত হচ্ছে, তেমনি সাধারণ বিনিয়োগকারী-উদ্যোক্তাদের ওপর বড় চাপ সৃষ্টি হয়েছে। তারা আশঙ্কা করছেন, এভাবে খেলাপি হয়ে পুনঃবিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যাবে। ধস নামবে ব্যবসায়।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম আমার দেশকে বলেন, ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের যে অস্বাভাবিক তথ্য দেখা যাচ্ছে এটা দীর্ঘদিনের অনিয়ম-লুটপাটের ফসল। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণদাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে পড়েও কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এসব সিদ্ধান্ত ব্যবসা-বাণিজ্যকে স্থবির করে তুলছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা চলছে, এটাও হঠাৎ খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণ হতে পারে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংককে নীতির পরিবর্তন করে বিনিয়োগবান্ধব সহায়ক নীতিতে আসতে হবে।
তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি হয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। গত মার্চের শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। তিন মাসের ব্যবধানে বা মার্চের তুলনায় জুনে খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৯৪ কোটি টাকা। আর এক বছরের হিসাবে বেড়েছে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। গত বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা বা ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান আমার দেশকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক মানে ঋণ শ্রেণিকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগে যে ঋণ ৯ মাস অনাদায়ী থাকলে খেলাপি হতো এখন তা তিন মাস অনাদায়ী থাকলে খেলাপি হচ্ছে। আবার গত সরকারের আমলে প্রভাবশালীদের ঋণ খেলাপি হয়ে গেলেও তা খেলাপির খাতায় দেখানো হতো না। এখন তা দেখানো হচ্ছে। এছাড়া দেশের অর্থনীতি পরিস্থিতিও একটু অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণ বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী আমার দেশকে বলেন, বিগত সরকারের আমলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং সুবিধাভোগীদের ছত্রছায়ায় ঋণখেলাপির কালচার গড়ে তুলেছে। ওই সময় ঋণ পুনঃতফসিল ও সুদ মওকুফসহ নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ফলে একটা ভঙ্গুর ব্যাংক ব্যবস্থা দেখতে পাচ্ছি। বর্তমান সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা ছিলÑ যেসব কারণে ব্যাংকগুলোর ভঙ্গুর অবস্থা তৈরি হয়েছে, তাদের জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেবে, যাতে ব্যাংকগুলো ঋণখেলাপির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু বাস্তবে সে ধরনের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বরং আগের মতোই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ আদায়ে উদ্যোগ নিচ্ছে না। ফলে খেলাপি ঋণ আরো বেড়ে যাচ্ছে।
খেলাপি ঋণ যে এভাবে লাফিয়ে বাড়বে তা আগেই ধারণা দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। গত আগস্টে দায়িত্ব নেওয়ার পরই তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ অনেক বাড়বে। গত ফেব্রুয়ারিতে আগের সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, খেলাপি ঋণ আরো বাড়বে। কোনো তথ্য লুকিয়ে রাখা হবে না। তবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর পর এটা আবার কমবে। এছাড়া নতুন করে বিতরণ করা ঋণ যেন খেলাপি না হয় সে জন্য বিভিন্ন আইনি কঠোরতা আনা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, মেয়াদি ঋণখেলাপির সময় পুনর্নির্ধারণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে কিছু বড় অঙ্কের ঋণ বিরূপমানে শ্রেণিকৃত হওয়ায় এভাবে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এছাড়া গ্রাহকের চলতি ঋণ নবায়ন না হওয়া, পুনঃতফসিল করা ঋণের কিস্তি যথাসময়ে পরিশোধ না হওয়া এবং বিদ্যমান খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে সুদ যোগ হয়ে বেড়েছে খেলাপি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এর পর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। অর্থনীতিবিদরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছেন, তৎকালীন সরকারের ছত্রছায়ায় ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাট হয়েছে, যার একটা বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করে। সাবেক সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে প্রভাবশালীদের বড় অঙ্কের ঋণ দিয়ে নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কম দেখাতে নেওয়া হয়েছিল একের পর এক নীতি। সরকার পরিবর্তনের পর সেই নীতি থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।