ডেস্ক রিপোর্ট:
টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ফেনীর ৩ নদীর বেড়িবাঁধে ২১ স্থানে ভাঙ্গণ ধরেছে। এতে জেলার ৩ উপজেলায় ১০৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এছাড়াও বন্যা কবলিত এ জেলায় কারেন্ট জালে জড়িয়ে এক বৃদ্ধের মৃত্যু ও সাপের কামড়ে ১ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এদিকে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর ১২২ কি.মি. বেড়িবাঁধের অনেক এলাকা এখনও ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড।
স্থানীয় জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত পরশুরাম উপজেলার ২৭টি, ফুলগাজী উপজেলার ৬৭টি, ছাগলনাইয়া উপজেলার ১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার অন্তত ৭০টি আশ্রয়কেন্দ্রে বন্যাদুর্গত প্রায় ৯ হাজার মানুষ অবস্থান নিয়েছেন। প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে ইতোমধ্যে ১২০ জন স্বেচ্ছাসেবক মাঠে কাজ করছে।
ছাগলনাইয়া উপজেলার বাসিন্দা শেখ কামাল বলেন, পরশুরাম-ফুলগাজীর ভাঙন স্থান দিয়ে আসা পানিতে ছাগলনাইয়া উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। সড়কগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে, ব্যাহত হচ্ছে যান চলাচল। সময়ের সঙ্গে পানির চাপ বাড়ছে।
ছাগলনাইয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুবল চাকমা বলেন, মাঠপর্যায়ে থেকে দুর্গত মানুষের সহায়তায় আমরা সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রয়েছি। উপজেলায় ২০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে ছাগলনাইয়ার বিভিন্ন এলাকায় তীব্র স্রোতে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে।
ফুলগাজী উপজেলার নোয়াপুর গ্রামের আসিয়া বেগম বলেন, ‘মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে হঠাৎ বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে পড়ে। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাদের ঘরবাড়ি, পুকুর সব কিছু পানিতে তলিয়ে গেছে। আমাদের ঘরে কোমর সমান পানি।’
একই গ্রামের মানিক চন্দ্র পালের নতুন মুরগির খামার বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমার সব শেষ হয়ে গেছে। এখন আর আমরা কিছু নেই।’ তার দাবি, ‘বেড়িবাঁধ না ভাঙলে এই অবস্থা হতো না।’
পরশুরাম উপজেলার মির্জানগরের সত্যনগর গ্রামের বাসিন্দা মিন্টু হাওলাদার বলেন, ‘প্রতিবছরই আমরা এমন পরিস্থিতির শিকার হই। এক মাস আগেও আমাদের এলাকায় বন্যা হয়। তখন বাঁধগুলো মেরামত করা হয়েছিল। কিন্তু তা নামে মাত্র। গত রাতে নদীর পানি বিপৎসীমার উপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সবগুলো বাঁধ ভেঙে যায়।’
বন্যা পরিস্থিতির খবর জানতে চাইলে ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহরিয়া ইসলাম বলেন, ‘ভাই আপনারা আমাকে সাহায্য করুন। আমি আমার উপজেলার পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার করতে পারছি না। অসহায়ের মতো বসে আছি। আমার নৌকা দরকার। নৌকা ছাড়া তাদের আমি কীভাবে উদ্ধার করব!’
তিনি বলেন, ‘আমার আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত আছে। তাদের জন্য খাবারসহ সব প্রস্তুতি আছে। কিন্তু তাদের আমি কীভাবে আশ্রয়কেন্দ্রে আনব? তাদের কাছে যাওয়ার তো কোনো উপায় নেই। তারাও তো আসতে পারছেন না। আমি অসহায় হয়ে পড়েছি। আমার এখন প্রয়োজন নৌকা। পানিবন্দি মানুষকে নৌকা ছাড়া তো উদ্ধার করতে পারব না।’
তিনি জানান, ‘পুরো উপজেলার সব ইউনিয়নেই বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। পরিস্থিতি খুবই খারাপ। আশ্রয় কেন্দ্রও এখন ডুবে যাচ্ছে। মানুষকে কীভাবে রক্ষা করব তাই বুঝে উঠতে পারছি না।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, ফেনী সদর, ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার কমপক্ষে ২১টি জায়গায় বেড়িবাঁধ ভেঙে হু হু করে পানি ঢুকছে। ফলে তিনটি উপজেলার প্রায় সব গ্রামই পানিতে তলিয়ে গেছে। পানির তোড়ে অনেকের ঘর-বাড়ি, গবাদিপশু, খামার, ফসল ভেসে গেছে।
অপরদিকে সোনাগাজী উপজেলার নবাবপুর, আমিরাবাদ ও চরদরবেশ ইউনিয়নের নদী তীরবর্তী এলাকায় ফের আগ্রাসীরূপে ভাঙন দেখা দিয়েছে। পানির তোড়ে ধসে পড়েছে উপজেলার ৩টি সড়ক। এতে বন্ধ রয়েছে যানচলাচল। ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে মসজিদ ও বসতবাড়ি। ফলে আতঙ্কে দিন পার করছেন নদী পাড়ে বসবাসরত মানুষজন।
সরেজমিন দেখা যায়, উপজেলার নবাবপুরের মজুপুর গ্রামে কালিদাস পাহালিয়া নদীর পাড়ে ফের ভাঙন শুরু হয়েছে। চরদরবেশ ইউনিয়নের সাঈদপুর গ্রামে ছোট ফেনী নদী অংশে আগ্রাসীরূপে ফসলি জমিসহ ভাঙছে নদীর পাড়। এছাড়া আমিরাবাদ ইউনিয়নের পূর্ব সোনাপুর গুচ্ছগ্রাম অংশে ফেনী নদীর তীর ভেঙে তলিয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বড় ফেনী নদী ও ছোট ফেনী নদী থেকে দীর্ঘদিন অবৈধ বালু উত্তোলনের প্রভাবেই এ ভাঙন তীব্র হচ্ছে। পাশাপাশি গত বছরের বন্যায় মুছাপুর রেগুলেটর বিলীনে নদীগুলো হারিয়েছে স্বাভাবিক গতিপথ। এতে প্রতিনিয়ত সরাসরি জোয়ারের পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে।
সাব্বির হোসেন নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, উপজেলার চরদরবেশ ইউনিয়নের বাঁশপাড়া সড়ক, তাকিয়া বাজার থেকে চরমজলিশপুরে যাওয়ার বদরপুর সড়ক ও মিয়াজী ঘাট সড়ক ধসে পড়েছে। এতে যানচলাচল ব্যাহত হয়ে মানুষজন বিপাকে পড়েছেন।
এ ব্যাপারে সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজিয়া হোসেন বলেন, তিন এলাকায় নদী ভাঙন ও তিনটি স্থানে সড়ক ধসে পড়ার ঘটনায় পানি উন্নয়ন বোর্ড, এলজিইডিসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হয়েছে। মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে দ্রুত কাজ শুরু করতে বলা হয়েছে। বৈরি আবহাওয়ায় দপ্তরগুলোর কাজ শুরু হতে বিলম্ব হওয়ায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চরদরবেশ ইউনিয়নের সাঈদপুর গ্রামে ছোট ফেনী নদীর ভাঙন অংশে মেরামতের কাজ শুরু করা হয়েছে। এছাড়া সড়কগুলো চলাচল উপযোগী করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
জেলা আবহাওয়া কর্মকর্তা মজিবুর রহমান জানান, গত তিন দিনে এই মৌসুমে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে ফেনীতে। আগামী শনিবার পর্যন্ত মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ১৪১ মিলিমিটার।
উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম বলেন, ‘ফেনী জেলায় ১২২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আছে। বলতে গেলে এর পুরোটাই ঝুঁকিপূর্ণ। ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত একটি প্রজেক্ট ছিল, তখন বাঁধ মেরামত করা হয়। এরপর আর মেরামত করা হয়নি। পুরো ফেনীর বন্যা প্রতিরোধ এই বেড়িবাঁধের ওপর নির্ভর করে। মুহুরী, কহুয়া, সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে গেলে ফেনীকে রক্ষা করা যায় না। এ তিন নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে গেলে বাঁধ ভেঙে জনপদ তলিয়ে যায়।’
জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। সব জায়গায় উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। কোথাও যদি ত্রাণ না পৌঁছায়, তবে সেখানেও পাঠানো হবে।
উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমে নেমেছে সেনাবাহিনী-বিজিবি
ফেনীতে অবস্থিত সেনাবাহিনী ক্যাম্পের উপ-অধিনায়ন মেজর আরেফিন শাকিল আমার দেশকে বলেন, বন্য কবলিত পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলার সেনাক্যাম্পে বৃহস্পতিবার ট্রাইশার্ক বোট, ওবিএম ইঞ্জিন এবং লাইফ জ্যাকেট দেওয়া হয়েছে; যা উদ্ধার ও ত্রাণ কাজে ব্যবহার করা হবে। এছাড়াও জরুরি পরিস্থিতিতে চিকিৎসা সেবা নির্বিঘ্ন রাখতে সেনাবাহিনীর একটি চিকিৎসক দল জেলা সিভিল সার্জনের সাথে সমন্বয় করছে।
সেনাবাহিনী জানায়, জাতির দুর্যোগকালীন মুহূর্তে জনগণের পাশে রয়েছে সেনাবাহিনী। প্রয়োজনীয় সহায়তার জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, ফেনী বন্যা মনিটরিং সেল হেল্পলাইন নম্বর ০১৮৯৮৪৪৪৫০০ এবং ০১৩৩৬৫৮৬৬৯৩ এ যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হলো।
অন্যদিকে পানিবন্দি মানুষজনকে বুধবার রাত থেকে রান্না করা খাবার বিতরণ করছে বিজিবি। বৃহস্পতিবারও ফুলগাজী-পরশুরামের বিভিন্ন স্থানে খাবার বিতরণ করেছে বিজিবি সদস্যরা।
কলাগাছের ভেলায় হাসপাতালে নেওয়া হয় অন্তঃসত্ত্বাকে
ফুলগাজীর কামরুন নাহার নামে এক অন্তঃসত্ত্বাকে স্বেচ্ছাসেবীদের সহায়তায় কলাগাছের ভেলায় হাসপাতালে নিয়ে গেছেন স্বজনরা। বুধবার দুপুরে ভেলায় করে উপজেলা বাজার পর্যন্ত নেওয়া হয় অন্তঃসত্ত্বা কামরুন নাহারকে। এরপর পিকআপে করে তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। ফেনীর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে কন্যাসন্তানের জন্ম দেন কামরুন নাহার।
অপরদিকে বিষধর সাপের কামড়ে আহত এক সন্তানকে নিয়ে ফুলগাজীর মুন্সীরহাটের দক্ষিণ শ্রীপুরের এক মা’কে হাসপাতালের দিকে যেতে দেখা গেছে।
ফেনীর সিভিল সার্জন মোহাম্মাদ রুবাইয়াত বিন করিম বলেন, বন্যাকবলিত এলাকায় রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সব উপজেলা পর্যায়ে মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বন্যা চলাকালীন ও পরবর্তী সময়েও এসব টিম কাজ করে যাবে।
বন্যার পানিতে কারেন্ট জালে জড়িয়ে বৃদ্ধের মৃত্যু
ফেনীতে বন্যার পানিতে কারেন্ট জালে জড়িয়ে নুরুল আলম নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার ফুলগাজী উপজেলার আনন্দপুর ইউনিয়নের বন্দুয়া দৌলতপুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত আলম ওই এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক কমান্ডারের ছেলে। ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারিয়া ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক
বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে মুসাপুর রেগুলেটর ও ফেনীতে বন্য নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প চূড়ান্ত করা ও নোয়াখালীর খাল ও ড্রেনেজ অবমুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে উপদেষ্টামণ্ডলীকে অবহিত করা হয়েছে।
এছাড়া বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে উল্লিখিত জেলার ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামত, তীর প্রতিরক্ষা ও পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো মেরামতের কাজ চলমান রয়েছে মর্মে জানানো হয়েছে বলেও জানিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।