সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। ভারতের শিলিগুড়ি করিডোরে উন্নত সামরিক অস্ত্র মোতায়েন, চীনের সম্ভাব্য সামরিক আগ্রহ এবং যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সতর্কতা সব মিলিয়ে বাংলাদেশের জন্য তৈরি হয়েছে এক চরম কূটনৈতিক ও নিরাপত্তাগত চ্যালেঞ্জ।
ভারতের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, শিলিগুড়ি অঞ্চলে রাফায়েল যুদ্ধবিমান এবং রাশিয়ার S-400 এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম মোতায়েনের উদ্দেশ্য মূলত চীনের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই এলাকা বাংলাদেশের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সীমান্তবর্তী অঞ্চল। ফলে এসব আধুনিক সমরাস্ত্রের মোতায়েন ঢাকাকে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপে ফেলে দিচ্ছে।
অন্যদিকে, বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, চীন বাংলাদেশে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের আগ্রহ দেখাচ্ছে। চীনের এই পদক্ষেপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যেই বাংলাদেশকে সতর্ক করেছে। ভারতের অবস্থানও একই রকম হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতিতে যেকোনো একদিকে সামান্য ঝুঁকে পড়লেই অন্য পক্ষের তীব্র প্রতিক্রিয়া আসার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে বাংলাদেশ কি এই ত্রিমুখী চাপে পড়েই যাবে, না কি কোনো কৌশলগত ও স্মার্ট পন্থায় উত্তরণের পথ খুঁজে নেবে?
এখানে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক উদাহরণ হলো কাতারের পদক্ষেপ। ২০১৭ সালে সৌদি আরব ও তার মিত্ররা যখন কাতারের উপর অবরোধ আরোপ করে এবং বিভিন্ন শর্ত দিয়ে সার্বভৌমত্ব হরণ করতে চায়, তখন কাতার কোনো পরাশক্তির ঘাঁটি নয়, বরং মুসলিম বিশ্বে আস্থাভাজন এবং সামরিক শক্তির দিক থেকে শক্তিশালী মিত্র তুরস্ককে বেছে নেয়।
তুরস্ক একদিনের মধ্যে সংসদে বিল পাস করে ৫০০০ সেনা পাঠায় এবং দোহায় সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে। এর ফলে সৌদি আরব কিংবা যুক্তরাষ্ট্র কেউই কাতারের বিরুদ্ধে আর কিছু করতে পারেনি। কাতারের এই কৌশল প্রমাণ করে, সময়োপযোগী ও কৌশলগত সিদ্ধান্তই সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রধান হাতিয়ার হতে পারে।
বাংলাদেশও চাইলে একই পথ অনুসরণ করতে পারে। তুরস্ক বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের অকৃত্রিম বন্ধু। পাশাপাশি এটি একটি শক্তিশালী সামরিক শক্তি এবং NATO সদস্য। বাংলাদেশের সঙ্গে তুরস্কের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার করলে, একদিকে যেমন তা ভারতের জন্য সরাসরি চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে না, অন্যদিকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকেও ভারসাম্য রক্ষার বার্তা দেওয়া যাবে।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ চাইলে তুরস্কের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা কাঠামো তৈরি করতে পারে, যার আওতায় বাংলাদেশে সামরিক বেইজ (ঘাঁটি), যৌথ সামরিক মহড়া, প্রশিক্ষণ, প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি বিনিময় এবং প্রয়োজনে সামরিক সহায়তা অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। এতে বাংলাদেশ কারো প্রতিপক্ষ না হয়েও নিজের জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বাস্তবিক প্রস্তুতি নিতে পারবে।
আমরা মনে করি, আজকের বিশ্বে এককভাবে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা কঠিন হলেও কৌশলগত ভারসাম্য (Strategic Balancing) এবং স্মার্ট অংশীদারিত্ব (Smart Partnerships) গড়েই ছোট রাষ্ট্রগুলো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছে। বাংলাদেশকেও সেই পথেই হাঁটতে হবে।
তবে মনে রাখতে হবে এই সিদ্ধান্ত হঠকারী নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি কূটনৈতিক পরিকল্পনার অংশ হতে হবে। এমন কৌশল নির্ধারণ করতে হবে, যাতে বাংলাদেশ নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে এবং একই সঙ্গে কারো প্রভাবাধীনও না হয়।
অতএব, এখনই সময় কৌশলগত ও স্মার্ট পররাষ্ট্রনীতির। কাতারের মতো সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশও প্রমাণ করতে পারে ছোট রাষ্ট্র হলেও চাপে নয়, নীতিতে পথ চলে সে।
~কাওছার আহমেদ, সম্পাদক, তেঁখ বাংলা