আমার স্মৃতিতে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান 

মোহাম্মদ মাহবুব হোসাইন

জীবন চলার পথে কিছু কিছু  স্মৃতি আছে; যা সারা জীবন সঙ্গী হয়ে জীবনের সাথে চলে।এমন তিনটি স্মৃতি যা আমার জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে  জড়িয়ে আছে।দুটি পরিচয়ে আর অপরটি বিদায় লগ্নে। 

১৯৮০ সালের জানুয়ারি মাস, তারিখটি মনে নেই।

ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী ও মালিবাগ এলাকা সাঁজ সাঁজ রব।সবাই যেনো আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেছে। বিভিন্ন বয়সের মানুষের উৎসবমুখর সমাগম।

দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি আসছেন দুটি স্কুল পরিদর্শনে। আমাদের নিয়ে সে কি দৌড়ঝাঁপ। কারা কারা রাষ্ট্রপতিকে ফুল দেবেন আর কেমন পোশাকে সজ্জিত হবো আমরা ইত‍্যাদি।আমি তখন শান্তিবাগ প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র। বড় ভাই মোহাম্মদ মোশাররফ হোসাইন সিদ্ধেশ্বরী হাই স্কুলের ছাত্র। মূলত তাঁর কারনেই আমি রাষ্ট্রপতিকে ফুল দেবার দলে স্থান পেয়ে গেলাম।

সকাল থেকেই নতুন পোশাকে ফুলের তোরা হাতে আমরা শিশুরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির আগমনের অপেক্ষায় প্রহর গুনছি। সমগ্র এলাকা লোকে লোকারণ্য।আয়োজকরা এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছেন। যতটা মনে পড়ছে তখন ঘরিতে বেলা সারে এগারোটা। হঠাৎ সাইরেনের শব্দ কানে ভেসে আসলো।সবাই বলে উঠলো, রাষ্ট্রপতি আসছেন।

রাস্ট্রীয় গার্ড সজ্জিত একটি সাদা রঙের গাড়ি থেকে ধুসর বর্নের সাফারী পোষাক আর সোনালী রঙের চশমা পরিহিত মহামান‍্য রাষ্ট্রপতি নেমে এলেন অপেক্ষামান জনতার মাঝে।কোনো রকম নিরাপত্তার তোয়াক্কা না করে হাসিমুখে একের পর এক সবার সাথে হাত মেলাতে মেলাতে সরাসরি চলে গেলেন মঞ্চের  দিকে। আমরা শিশুরাও ছুটলাম তাঁর পিছে পিছে। যে করেই হোক রাষ্ট্রপতির হাতে ফুলের তোরা দেওয়া চাই।এরই মধ্যে মাইকে মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে মঞ্চে আসন গ্রহণ করার জন‍্য আহ্বান করা হলো।

এর পরেই ঘোষণা হলো ফুল দিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতির জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ফুল দিয়ে বরন করে নেওয়ার। মুক্তিযুদ্ধের ১১ টি সেক্টরের পক্ষ থেকে আমরা ১১ জন শিশু রাষ্ট্রপতির জিয়াউর রহমানকে ফুলের তোরা দিয়ে বরণ করে নিয়েছিলাম।তিনি আমাদের প্রত‍্যেকের মাথায় হাত রেখে আদর করেছিলেন।এর পর রাষ্ট্রপতি তাঁর বক্তব্য রাখলেন।ভরাট কন্ঠে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” বলে বক্তব্য শুরু করলেন।সেদিনের সেই ভরাট কন্ঠের ভাষণ আজও আমার কর্ণকুহরে বাজে।

১৯৮০ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশন কর্তৃক আয়োজিত নতুন কুঁড়ি জাতীয় শিশু-কিশোর প্রতিযোগিতায় চূড়ান্ত পর্বে আমি আবৃত্তিতে ২য় স্থান লাভ করি ঢাকা বিভাগের প্রতিযোগী হিসেবে।

পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার প্রদান করেন। অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি সকল প্রতিযোগীর সাথে মঞ্চে “প্রথম বাংলাদেশ” গানটি সমবেত গাইলেন।গান শেষে তিনি আমাদের সকলের সাথে করমর্দন করলেন।শিশুদের প্রতি রাষ্ট্রপতি জিয়ার প্রগাঢ় ভালোবাসা বিদ্যমান ছিল।যে কারনে শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশের লক্ষ‍্যে তিনি শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, শিশু পার্ক, শিশু একাডেমী সহ নানা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

১৯৮১ সাল‍ের ৩০ মে ঘুম থেকে জেগে যথারীতি সবার স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে।মা নাস্তা তৈরীতে ব‍্যস্ত।বাবা সাধারণত ফজরের নামাজ শেষে বাড়ির আঙ্গিনায় রেডিও হাতে নিয়ে পায়চারী করেন।৭ টার সংবাদ শুনে নাস্তার টেবিলে আসেন।

হঠাৎ বাবা চিৎকার দিয়ে মাকে ডেকে বললেন, রাষ্ট্রপতি জিয়া চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে কতিপয় বিপদগামী সেনা সদস‍্যের হাতে নিহত হয়েছেন।

আমার যতটুকু মনে পড়ছে আমার মায়ের হাতে থাকা রুটি বানানোর বেলুনটি হাত থেকে পড়ে যায়। বাবার চোখ ছলছল করে উঠলো। যেনো মূহুর্তের মধ‍্যে গোটা বাড়িটা বিস্বাদে ভরে উঠলো। বাবা আমাদের বললেন, কাউকে স্কুলে যেতে হবেনা।

বাবা-মার সাথে আমরা কিছুক্ষন পরপর রেডিওর ঘোষণা শুনছিলামন। ঘোষণার মাঝে কুরআন তেলাওয়াত ও হামদ নাত পরিবেশন চলছিল।

এরই মধ্যে রেডিও ঘোষণায় রাস্ট্রীয় শোকের ঘোষনা আসলো। সকাল আনুমানিক ৯টার সময় বাবার সাথে মালিবাগ মোড়ে গেলাম। চারিদিকে শুনশান নিরবতা।বাবার সাথে যারই দেখা হচ্ছে; সবার চোখে মুখে এক ধরনের দুঃখবোধ লক্ষ‍্য করেছি।

আমার বেড়ে ওঠার সাথে সাথে দেশ সম্পর্কে ধীরে ধীরে অনেক কিছু জানার সুযোগ হয়েছে।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর দেশের মানুষ যেভাবে কেঁদেছে, তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।

তার জানাজা ও দাফনের দিন বাবার সাথে আমি ও আমার বড় ভাই মোহাম্মদ মোশাররফ হোসাইন গিয়েছিলাম ।মালিবাগ থেকে পায়ে হেঁটে জাতীয় সংসদের দিকে জনস্রোত ঠেলে সেখানে পৌঁছতে আমাদের অনেক বেগ পেতে হয়েছে।

অগনিত মানুষের ভিড়ে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কফিন অনেকের দেখার সুযোগ না হলেও, সবাই এই জনপ্রিয় রাস্ট্র নায়ককে হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিল সেই সময় আমার মনে হয়েছে।

জানাজা চলাকালীন সময় কোটি মানুষের ডুকরে ওঠা কান্নার ধ্বনি আকাশ-বাতাস ভারী করে তুলেছিল।

আমার পাশেই একজন বয়স্ক মানুষ দাঁড়িয়ে ছিলেন।

জানাজা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম, সেই বয়স্ক লোকটি কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।

সেদিন সবাই যেনো শোকে আর কষ্টে উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক সেদিক ছুটছিল। তারা কি যেনো হারিয়ে ফেলেছে এই চিন্তায় শোকে বিহ্বল হয়ে পরেছিল।

জানাজা শেষে ২৭ বার তোপধ্বনির মধ‍্যদিয়ে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় সামরিক মর্যাদায় একজন দেশপ্রেমিক সফল রাষ্ট্রনায়ক শহীদ জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ঐতিহাসিক আঙ্গিনায় সমাহিত করা হয়।

রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের বিদায় অনুষ্ঠানে সেদিন যে জনসমাগম হয়েছিল তা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন বলে বিশ্ব মিডিয়া মন্তব্য করেছিল।

যেনো মনে হয়েছিল গোটা বাংলাদেশ শহীদ জিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।তাইতো তাঁর শাহাদাতের পর যথার্থ লিখেছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন‍্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ,”একটি কফিনের পাশে বাংলাদেশ।”

১৯৭৫ এর সাত নভেম্বর সিপাহী-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সেনানিবাসের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে এই দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসিয়েছিল। গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে যখন তিনি দেশকে স্বনির্ভরতার দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন এবং দেশে পূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে এনে বহুদলীয় গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। 

আর তারই ধারাবাহিকতায় আওয়ামীলীগ নেতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের জৈষ্ঠ্য কন‍্যা শেখ হাসিনা ওয়াজেদকে ১৭ মে ১৯৮১ ভারত থেকে দেশে এনে রাজনৈতিকভাবে পূর্ণবাসন করেছিলেন।

শেখ হাসিনা যখন দেশে ফিরেছিলেন , সেই সময়কার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আমার সাংবাদিকতা জীবন ও সামাজিক আন্দোলনের শিক্ষক সাবেক মন্ত্রী সাংবাদিক জগতের কিংবদন্তি  জননেতা মরহুম আনোয়ার জাহিদ নব্বই দশকের শুরুতে ঐতিহাসিক দৈনিক বাংলা মোড়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত সংগঠন জাতীয় যুব কমান্ড আয়োজিত একটি সমাবেশে বলেছিলেন, সেই সময় ঢাকার দেওয়াল গুলোতে লেখা হয়েছিল, শেখ হাসিনা আসছে জিয়ার গদি কাঁপছে।তিনি বলেন, শুধু কাঁপেই নাই;  মাত্র তের দিনের মাথায় বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রান পুরুষ জেনারেল জিয়া শাহাদাত বরন করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি জিয়া হত‍্যা আর সে সময়ের দেওয়াল লেখনি একই সূত্রে গাঁথা বলেও তিনি জিয়া হত‍্যার পিছনে শেখ হাসিনার হাত রয়েছে মর্মে অভিযোগ করেন।

৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের পর বিএনপি তিনবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল কিন্তু তারপরও রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়া হত‍্যার ব‍্যাপারে কোনো প্রকার পদক্ষেপ নেয়নি।সেই সময় যদি বিএনপি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া হত‍্যার তদন্দ করতো তাহলে দেশের ইতিহাস ভিন্নভাবে লেখা হতো।

এছারা আরও একটি বিষয় বিএনপি করতে পারেনি, তাহলো ক্ষমতায় থাকা সত্তেও; দেশের জন‍্য জীবন দানকারী মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাত দিবসটি  জাতীয় শোক ও রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষনা করতে পারেনি।

আরও একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, ১৯৯৬ সালে ঐক‍্যমতের সরকারের নামে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে ফ‍্যাসিবাদী কায়দায় ৭ নভেম্বরের “জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি” দিবসের ছুটি বাতিল করে দেয়।সে সময় দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন সমূহ এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ করেছিল।

আমিও এ বিষয়ে একটি প্রতিবাদী প্রবন্ধ লিখেছিলাম।এই প্রবন্ধ দৈনিক দিনকাল ও দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।

এই প্রবন্ধের এক জায়গায় আমি লিখেছিলাম, পর্যবেক্ষক মহলের ধারনা ৭ নভেম্বরের ছুটি বাতিল হলে দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃস্টি হবে। এই প্রবন্ধ লেখার অপরাধে ১২ আগস্ট ১৯৯৬ আমাকে মতিঝিলের অফিস থেকে সিটি এস বি’র একটি বিশেষ টিম সাদা পোষাকে গ্রেফতার করে।দীর্ঘ তিন মাস ফ‍্যাসিস্ট শেখ হাসিনার কারাগার থেকে হাইকোর্টের মাধ‍্যমে অন্তর্বতিকালিন জামিনে মুক্তি লাভ করি। ঐ সময় দেশের হাইকোর্ট অনেকাংশে স্বাধীন ছিল।

আজ শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের রক্তে গড়া বাংলাদেশ ফ‍্যাসিবাদী আওয়ামী মুক্ত। গত ৫ আগষ্ট ২০২৪ ছাত্র-জনতার সাহসী ভূমিকা এবং প্রায় দুই সহস্রাধিক জীবনের বিনিময়ে বিপ্লবের মধ‍্যদিয়ে পনের বছরের আওয়ামী ফ‍্যাসিবাদের উৎখাতের মাধ‍্যমে এক নতুন বাংলাদেশ তার সফর শুরু করেছে।

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৪৪ তম শাহাদাত বার্ষিকীতে আজ শপথ হোক জাতিয়তাবাদী আর্দশে অনুপ্রানীত হয়ে সমমনা রাজনৈতিক শক্তি ও ইসলামী দলসমূহের সাথে মেলবন্ধন  করে সকল বাঁধা পায়ে দলে স্বকীয় বাংলাদেশ বিনির্মানে প্রানপণ প্রচেষ্টা অব‍্যাহত রাখতে ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী

Share