সাংবাদিক ও রাজনীতিক শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা: কিছু স্মৃতি কিছু কথা

মোহাম্মদ মাহবুব হোসাইন:

কোন স্মৃতিকথা দিয়ে শুরু করব তা নিয়ে কিছুটা চিন্তায় পরে গিয়েছিলাম। অনেক বছর আগের কথা। বছর কিংবা তারিখ দুটোর একটাও মনে নেই। পরিচয়ের ঘটনাটা বেশ মনে পরছে। বাংলাদেশের জাতীয় মুল্যবোধকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যে স্বৈরশাসক ধ্বংস করার জন্য মূলত দায়ি সেই জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলের শেষ দিকে যখন গণ আন্দোলন তুঙ্গে তখন আমদের এলাকার অনেকেই ফজর নামাজের পর খিলগাঁও বিশ্বরোডে বিভিন্ন জায়গায় দাড়িয়ে ব্যায়াম করতেন। আমি ও আমার সমবয়সী বন্ধুরা ব্যায়াম করতাম খিলগাঁও পোস্ট অফিসের সামনের রাস্তায়।সেই সময় আমাদের সাথে থাকতেন খিলগাঁও ইসলামী পাঠাগার ও সমাজকল্যাণ পরিষদের তৎকালিন সাধারণ সম্পাদক আমাদের সকলের প্রিয়জন ইকবাল করিম নেপু ভাই।একদিন ব্যায়াম করতে যেয়ে হঠাৎ দেখি একজন মধ‍্যবয়স্ক লোক আমাদের পিছনে দাঁড়িয়ে আমাদের সাথে ব্যায়াম করছেন।তাকে প্রথমে দেখে আমরা অনেকেই হাসাহাসি করছিলাম।নেপু ভাই ইসারায় আমাদের হাসতে নিষধ করলেন। ব্যায়াম শেষে লোকটি আমাদের সাথে কথা বললেন এবং তাঁর পরিচয় দিয়ে বললেন তিনি মীরবাগে থাকেন। এর পর থেকে প্রায়ই তিনি আমাদের সাথে ব্যায়াম করতে আসতেন। যতটা মনে পরে তাঁর সাথে তাঁর স্ত্রী হিজাব পরিধান করে হাটতে আসতেন।সেই থেকেই মূলত তাঁর সাথে আমার সখ্যতার সুত্রপাত।

শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে লেখক

১৯৯২ সালে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী ফ‍্যাসিবাদী আওয়ামীলীগের পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত সংগঠন “ঘাদানিক” এর অপতৎপরতা রুখতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত সংগঠন “জাতীয় যুব কমান্ড” গঠনের পর আমাদের অনুষ্ঠানে যে সকল জাতীয় নেতা এসে বক্তব্য রাখতেন; তাদের মধ্যে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ছিলেন অন্যতম। শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার বক্তব্য আমাকে বেশ আকৃস্ট করতো ।এর মূল কারন, তাঁর বক্তব্য অনেকটা ফরিদপুরের আঞ্চলিকতা যুক্ত থাকলেও বক্তব্যের মধ্যে থাকতো ইতিহাস নির্ভর বিশ্লেষণ এবং এরই আলোকে ভবিষ্যদ্বাণী ; যা অনেকটা আমার কাছে আশ্চর্য মনে হতো।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন সর্বজন শ্রদ্ধেয়া বেগম খালেদা জিয়া জেনারেল মঈন উ আহমেদকে যখন সেনাপ্রধান করেন, তখন শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ৪ দলীয় জোটের লিয়াজো কমিটির নেতা হিসেবে জেনারেল মঈন উ আহমেদকে সেনাপ্রধান না করার পরামর্শ দিয়েছিলন এবং বলেছিলেন জেনারেল মঈন “র” এর এজেণ্ট । ইতিহাস বলে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার সেই ভবিষ্যদ্বাণী শতভাগ প্রমানিত হয়েছিল। জেনারেল মঈন উ আহমেদ সংক্রান্ত একথা গুলো তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত আমার সাংবাদিকতার শিক্ষক প্রয়াত কিংবদন্তী সাংবাদিক ও সাবেক মন্ত্রী মরহুম আনোয়ার জাহিদের ১ম মৃত্যু বার্ষিকী’র অনুস্ঠানে ব্যাক্ত করেছিলেন । এ অনুস্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তথাকথিত যুদ্ধাপরাধ মামলার প্রহসন মূলক রায়ে ফাঁসির নামে হত্যার শিকার শহীদ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানটির আমি মডারেটের এর দায়িত্ব পালন করেছিলাম। তাঁর এই বক্তব্যের পর বেগম খালেদা জিয়া কিছুটা মনক্ষুন্ন হয়েছিলেন বলে মোল্লা ভাই কোন একটা অনুস্ঠান শেষে প্রেসক্লাবে চা পানের সময় এক প্রসঙ্গে তিনি একথা শেয়ার করেন।

৪ দলীয় জোট গঠনের পর তৎকালিন হাসিনা সরকার মরহুম আনোয়ার জাহিদ ও শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার উপর কড়া নজরদারি রাখতেন। সেজন্য আনোয়ার জাহিদ ভাই কৌশলগত কারনে প্রায়ই বাড়ডেমে ভর্তি হতেন।সেই সময় একদিন সন্ধ্যায় আমি ও জাতীয় যুব কমান্ডের সেক্রেটারি জেনারেল বর্তমানে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের রহমাতুল্লাহ আনোয়ার জাহিদ ভাইকে হাসপাতালে দেখতে যেয়ে দেখি শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ও আনোয়ার জাহিদ ভাই আলাপ করছেন । মোল্লা ভাই আমাদের দেখে বলেন, জাহিদ ভাই আপনার সৈনিকরা চলে এসেছে; আমার আর থাকার সুযোগ নাই। এ কথা বলে আমাদের খবরাখবর জিজ্ঞেস করে চলে গেলেন তিনি । শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইয়ের চলে যাবার পর মরহুম আনোয়ার জাহিদ মোল্লা ভাইয়ের চৌকস বুদ্ধি ও মেধার প্রশংসা করে বলেন, তাঁর মতো এ রকম আরও গোটা দশেক মোল্লা থাকলে জাতির চেহারাটাই বদলে যেতো।

তাঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ না হলেই টেলিফোনে খবর নিতেন। মূলত রাজনৈতিক কোন কর্মসূচী ছাড়া তাঁর সঙ্গে তেমন যোগাযোগ হতনা। মরহুম আনোয়ার জাহিদ এর মৃত্যু বার্ষিকী’র অনুস্ঠানে তাঁর সঙ্গে আমার সর্বশেষ দেখা। তিনি আনোয়ার জাহিদ ভাইয়ের ব্যাপারে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের পরামর্শ দেন। রাজনৈতিক কারনে আমার দেশত্যাগের ফলে সেটা আর আলোর মূখ দেখেনি।দেশত্যাগের ২ দিন আগে টেলিফোনে তাকে এ বিষয়ে অবহিত করলে তিনি ভাল থাকার জন্য দোয়া করেন।

আমি আগেও বলেছি রাজনৈতিক মতাদার্শ যাই থাকুক না কেনো , শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার মতো এমন হৃদয়বান ,জ্ঞানদীপ্ত, সৎ, নিরহঙ্কার ,প্রচারবিমুখ ও সাধারন জীবন ধারার মানুষ বাংলাদশে আর একজন জন্মাবেনা বলে আমি মনে করি। এমন একজন মানুষ শেখ হাসিনার রোষানলে পরে তথাকথিত যুদ্ধাপরাধ মামলার অবৈধ রায়ে ফাঁসির ছদ্মাবরনে হত্যার শিকার হতে হলো।
পৃথিবীর ইতিহাসকে ম্লান করে দিয়ে আইন পরিবর্তন করে তাকে হত্যা করা হয়। যদি সেদিন জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তি এক হয়ে এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসতো, তাহলে আজ দেশের ইতিহাস ভিন্নভাবে লেখা হতো। শুধু এতটুকু বলি, মোল্লা ভাই আমরা পারিনি…..

লেখক: সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী

Share