রাকসু ইলেকশন বনাম রক্তের ঋন ও শিবিরের নিকট মানবিক দায়

সরদার হাসান ইলিয়াছ তানিম:

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন কখনও কেবল ভোটের প্রতিযোগিতা নয়। এই ক্যাম্পাসের প্রতিটি গাছপালা, প্রতিটি ইট যেন সাক্ষ্য দেয় রক্তাক্ত নদী এবং অশ্রুধারার। এখানে লেখা আছে মজলুম শিক্ষার্থীদের হাহাকার ও আত্মত্যাগের ইতিহাস। আজও সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে বুক ভার হয়ে আসে, চোখ ঝাপসা হয়ে যায়। বাকরুদ্ধ হয়ে ক্রন্দন করি।

আমি সাংবাদিকতার সুবাদে অর্ধযুগেরও বেশি সময় কাটিয়েছি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। চোখের সামনে দেখেছি নিরীহ শিক্ষার্থীদের উপর অন্যায়ের নিষ্ঠুর আঘাত। শুধু নামাজ পড়ার জন্য, কোরআন হাতে নেওয়ার জন্য কত শিক্ষার্থীকে হকিস্টিক-রড দিয়ে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। কারও শরীর থেকে অঙ্গ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, কেউ কেউ হারিয়েছে জীবনের আলো। সেই আর্তনাদ, সেই কান্না এখনও ঘুরে বেড়ায় মতিহারের বাতাসে।

শরীফুজ্জামান নোমানী ছিলেন শিবিরের সেক্রেটারি, কিন্তু তার পরিচয় রাজনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি ছিলেন মজলুমদের প্রতীক। শিক্ষার্থীদের রক্ষায় নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে শহীদ হয়েছেন। তাকে হত্যার পর ছাত্রলীগের হিংস্র সন্ত্রাসীরা তার দেহ বিকৃত করেছিল। আমি সেই ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। আজও মনে হলে ঘুম ভেঙে যায়, চোখ ভিজে ওঠে অশ্রুতে। কোনো দলীয় বিভাজন নয়, আমার কাছে তিনি চিরকাল মজলুম শহীদ নোমানী।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস কেবল নোমানীর একার নয়। এখানে ছাত্রদলের আশিক ভাই, কামরুল ভাই, ভাগ্না পারভেজসহ অসংখ্য শিক্ষার্থী এবং অনেক সাংবাদিকও হয়েছেন নির্যাতনের শিকার। অন্যায়ের অন্ধকারে যারা আলো খুঁজছিল, তারা সবাই একইভাবে মজলুম।

আমি জামায়াতকে যৌক্তিকভাবে সমালোচনা করি এবং করব। তবে সাংবাদিক হিসেবে সত্য বলাই আমার দায়িত্ব। আর সত্য হলো—“যে মজলুম হয়ে ওঠে, সে রাজনৈতিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে যায়”। ইতিহাসে তাদের পরাজয় নেই।

শুনেছি রাবি ক্যাম্পাসে রাকসুর ইলেকশনে ছাত্রদল পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির প্রার্থী দিয়েছে। শিবিরও সর্বশক্তি দিয়ে শিক্ষার্থীদের হৃদয় জয় করতে চাইছে। কে সংখ্যায় জিতবে তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আসল বিজয় হলো সেই রক্তের প্রতি শ্রদ্ধা, সেই স্বপ্নের প্রতি দায়বদ্ধতা।

আমার ব্যক্তিজীবনের একটি মুহূর্ত আমি কখনও ভুলতে পারব না। হাসিনার সহযোগী ছাত্রলীগের নির্মম হামলায় যখন আমি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলাম, তখন তৎকালীন শিবির সভাপতি ড. মোবারক হোসাইন (পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় সভাপতি) বারবার আমার চিকিৎসার খোঁজ নিয়েছিলেন। আর তৎকালীন রাবির সেক্রেটারি আশরাফুল আলম ইমন ভাই আমাকে দেখতে এসেছিলেন। ফলমূল হাতে নিয়ে বসে ছিলেন আমার শয্যার পাশে। যখন আমার রক্তের প্রয়োজন হয়েছিল, তখন তাৎক্ষণিকভাবে শিবিরের এক ভাই নিজের শরীরের কথা চিন্তা না করে পরপর দুই ব্যাগ রক্ত দিয়ে আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। জীবন-মৃত্যুর মালিক আল্লাহ। মানুষ শুধু মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। সেদিন রক্ত না পেলে হয়তো আমাকে এই পৃথিবী ছেড়ে যেতে হতো।

সেদিন অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের কাউকে হাসপাতালে পাইনি। অবশ্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংবাদিকরা রাজপথে মানববন্ধনে অংশ নিয়েছিলেন। প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল মূলধারার গণমাধ্যমে। কিন্তু সার্বক্ষণিকভাবে আমার খোঁজ রেখেছিল কেবল শিবির।

মানুষের জীবনে কিছু মুহূর্ত থাকে, যেগুলো বিশ্বাস, আদর্শ ও তত্ত্বকে ছাপিয়ে যায়। আমার দুঃসময়ের সেই মুহূর্তগুলোই হৃদয়ে কৃতজ্ঞতার স্থায়ী দাগ এঁকে দিয়েছে। আমি বাংলাদেশ থেকে বহুদূরে অবস্থান করছি—ভূমধ্যসাগর বেষ্টিত পৃথিবীর বিখ্যাত নগরী ফ্রান্সের কান শহরে। হঠাৎ মনে হলো, যদি আজ আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকতাম, রাকসুর ইলেকশনে আমি শিবির সমর্থিত ভিপি প্রার্থী জাহিদ ও তার প্যানেলকে ভোট দিতাম। আদর্শিক কারণে নয়, বরং সেই মানবিক কৃতজ্ঞতা থেকে—সেই রক্তের ঋণ শোধ করার দায় থেকেই, যা তার পূর্বসূরীদের নিকট আমি দায়বদ্ধ।

পরিশেষে আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়—মজলুমের কান্না কোনোদিন বৃথা যায় না। সেই কান্নাই একদিন বজ্র হয়ে অন্যায়ের প্রাসাদ ভেঙে দেয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, শেষ পর্যন্ত বিজয় সবসময় মজলুমদেরই হয়। আমি বিশ্বাস করি, রাকসুর ইলেকশনে শিক্ষার্থীরা নির্যাতিত ও নিপীড়িত মজলুমদের আত্মত্যাগ ও তাদের প্রত্যাশাকে লালন করবে।

সাবেক সহ-সভাপতি
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব

Share