ফ্রান্সের ইতিহাস শুধু বিপ্লব, রাজতন্ত্রের পতন কিংবা মুক্তির উল্লাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি একটানা রাষ্ট্রব্যবস্থার পুনর্গঠনের একটি চলমান অধ্যায়। যেখানে বিপ্লব, রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র আর একনায়কত্ব একই ইতিহাসের অংশ।ইউরোপের কল্যাণকামী উদার গণতান্ত্রিক ও মানবিক এই দেশটি একাধিকবার তার শাসনব্যবস্থা পাল্টেছে, এবং প্রতিষ্ঠা করেছে পাঁচটি আলাদা প্রজাতন্ত্র। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন বারবার ভেঙেছে তাদের রাষ্ট্র কাঠামো?। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দেশ বিরল, যেখানে গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য বারবার শাসনব্যবস্থা বদলাতে হয়েছে। ফ্রান্সের পাঁচটি প্রজাতন্ত্র সে ইতিহাসেরই ধারক। উল্লেখ্য ফ্রান্সের “সানকিয়েম রিপাবলিক” (Cinquième République) মানে “Cinquième” পঞ্চম, আর “République” মানে প্রজাতন্ত্র।ফ্রান্সের “সানকিয়েম রিপাবলিক” (Cinquième République) অর্থ হলো “পঞ্চম প্রজাতন্ত্র”এটি ফ্রান্সের বর্তমান শাসনব্যবস্থার নাম। ইংরেজিতে যাকে fifth republic/ফিফথ রিপাবলিক বলে।
প্রথম প্রজাতন্ত্রের (১৭৯২) জন্ম হয়েছিল রাজতন্ত্রের ধ্বংসস্তূপের ওপর। এটি ছিল সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার এক মহাপ্রয়াস। কিন্তু বিপ্লব-পরবর্তী বিশৃঙ্খলা, গৃহবিপ্লব ও রাজনৈতিক হত্যা এই আদর্শকে ক্ষতবিক্ষত করে তোলে। ফলে প্রজাতন্ত্র শেষ হয় নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায়।
দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের (১৮৪৮) অস্থায়ী উত্থান আবারও গণতন্ত্রের আশাকে জাগিয়ে তোলে। কিন্তু ইতিহাস যেন পুনরাবৃত্তি করে। রাজা লুই নেপোলিয়নের ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসন প্রজাতন্ত্রকে ছিঁড়ে ফেলে এনে দেয় দ্বিতীয় সাম্রাজ্য।
তৃতীয় প্রজাতন্ত্র (১৮৭০–১৯৪০) ছিল দীর্ঘস্থায়ী কিন্তু দুর্বল। এটি রাজনৈতিক মুক্তির ক্ষেত্র প্রস্তুত করলেও অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও যুদ্ধকালীন অক্ষমতা এটিকে ইতিহাস থেকে মুছে দেয়। চতুর্থ প্রজাতন্ত্র (১৯৪৬–১৯৫৮) এর উত্তরসূরি হয়—যা যুদ্ধোত্তর আশাবাদের ওপর দাঁড়ালেও আলজেরিয়া সংকট ও দুর্বল নেতৃত্বে হোঁচট খায়।
সবশেষে, ১৯৫৮ সালে শার্ল দ্য গলের উদ্যোগে জন্ম নেয় “ পঞ্চম প্রজাতন্ত্র “ ফ্রান্সের বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা। এখানে প্রেসিডেন্টকে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় এনে রাজনীতি ও প্রশাসনে স্থিতিশীলতা আনা হয়। এটি এখনও ফ্রান্সের গণতান্ত্রিক কাঠামোর মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে।
ফ্রান্সের প্রজাতন্ত্রগুলো শুধু শাসনব্যবস্থার নাম নয়। এগুলো এক একটি অধ্যায়, যেখানে প্রতিটি পতন ও প্রতিষ্ঠা ফরাসি জাতির স্বাধীনচেতা মানসিকতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অনুসন্ধানের প্রতিচ্ছবি । এই বারবারের রাষ্ট্রীয় রূপান্তর কেবল একটি শাসনব্যবস্থা বদলের ইতিহাস নয়, বরং এটি একটি জাতির গণতন্ত্রে বারবার ফিরে আসার সাহস, আত্মসমালোচনার শক্তি, ও পরিপক্ব রাষ্ট্রচিন্তার প্রতীক। গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করতে গিয়ে ফ্রান্স প্রমাণ করেছে অবিচল আদর্শের পেছনে বারবার পথ বদলানোও কখনো ব্যর্থতা নয়, বরং তা হয়ে উঠতে পারে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম সাফল্য।
~কাওসার আহমেদ, সম্পাদক, তেঁখ বাংলা