ইউরোপের অন্যতম উদার গণতান্ত্রিক দেশ জার্মানিতে নাৎসি বা নাজি বাহিনীর আদর্শ ও প্রতীকগুলো নিষিদ্ধ করার পেছনে ঐতিহাসিক, নৈতিক এবং রাজনৈতিক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে। নাৎসি শাসনের (১৯৩৩–১৯৪৫) সময় জার্মানিতে যে ধ্বংসাত্মক ও অমানবিক ইতিহাস তৈরি হয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা নিশ্চিত করার জন্য নাৎসি মতাদর্শকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়।
নাৎসি নিষিদ্ধ করার কারণ
প্রথমত অতীতের নিষ্ঠুরতা ও গণহত্যা: নাৎসি পার্টির শাসনামলে (১৯৩৩–১৯৪৫) ৬০ লাখ ইহুদি এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর উপর গণহত্যা (হলোকাস্ট) চালানো হয়েছিল। এই ইতিহাস জার্মানির জন্য গভীর লজ্জা এবং দায়িত্বের একটি অংশ।
দ্বিতীয়ত গণতন্ত্রবিরোধী আদর্শ: নাৎসিবাদ ছিল স্বৈরতান্ত্রিক ও জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ববাদী।
তৃতীয়ত ফ্যাসিবাদ ও সহিংসতা উৎসাহ দেওয়া: নাৎসি ভাবধারা সহিংসতা, বর্ণবাদ এবং বিদেশি বিদ্বেষ ছড়ায়, যা আধুনিক সমাজে অগ্রহণযোগ্য।
কিভাবে নাৎসি নিষিদ্ধ করা হয়
১৯৪৫-১৯৪৬ সালের মধ্যে জার্মানির নুরেমবার্গ শহরে নুরেমবার্গ ট্রায়াল অনুষ্ঠিত হয় ।নাজি পার্টি (Nazi Party) এবং তার সহযোগী সংগঠনসমূহকে নুরেমবার্গ ট্রায়ালের (Nuremberg Trials) মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে অপরাধী ঘোষণা করে নিষিদ্ধ করা হয়। নুরেমবার্গ ট্রায়াল ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে নাৎসি নেতা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনাল। ট্রায়ালে নাৎসি পার্টি, এসএস (SS), গেস্টাপো (Gestapo) এবং অন্যান্য সহযোগী সংস্থাকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর ফলে, এই সংগঠনগুলোর কার্যক্রম, সদস্য সংগ্রহ, প্রচারণা এবং প্রতীক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
আইনী ভিত্তি :
সুপ্রিম ‘ল’ অফ দ্যা ল্যান্ড জার্মানির সংবিধানের ২১ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যে কোনো রাজনৈতিক দল যদি গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চায়, তা নিষিদ্ধ করা যেতে পারে।তারপর Strafgesetzbuch (German Criminal Code)-এর ধারা 86 ও 86a অনুযায়ী, নাৎসি প্রতীক যেমন হিটলারের সালাম, স্বস্তিকা চিহ্ন (Swastika), এসএস বা এসএ ইউনিফর্ম ইত্যাদি প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়। এছাড়া according to Holocaust Denial Act , holocaust denial is a punishable offense under section 130, তাই হিটলার বা নাৎসিদের প্রশংসা বা হলোকাস্ট অস্বীকার করাও অপরাধ জার্মানিতে অপরাধ। সেই সাথে জার্মান সরকার বিবেক ও মূল্যবোধ গঠনের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থায়; স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নাৎসি ইতিহাস পড়ানো বাধ্যতামূলক, যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম সেই ভুল আর না করে। সর্বোপরি জার্মানির রাষ্ট্রীয় কাঠামো, সংবিধান এবং আইন-আদালত একত্রে কাজ করে নিশ্চিত করেছে যে নাৎসি মতবাদ কখনোই সমাজে আবার প্রতিষ্ঠা না পায়। এই নিষেধাজ্ঞা শুধু আইনগতই নয়, বরং নৈতিক এবং শিক্ষামূলক দৃষ্টিকোণ থেকেও জার্মান সমাজে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত।
এদিকে নতুন দল NDP ও একটি উগ্র-ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী দল, যার অনেক মতাদর্শ নাৎসিদের সঙ্গে মিল আছে।
তবে এটি আইনগতভাবে নাৎসি পার্টির উত্তরসূরি নয় এবং নিজেকে গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই পরিচালিত বলে দাবি করে। NDP একটি উগ্র-ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী দল, যার অনেক মতাদর্শ নাৎসিদের সঙ্গে মিল আছে।
তবে এটি আইনগতভাবে নাৎসি পার্টির উত্তরসূরি নয় এবং নিজেকে গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই পরিচালিত বলে দাবি করে।
তাই মৌলিক অধিকারের (যেমন: রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকার) প্রতি সম্মান দেখিয়ে দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়নি।
২০১৭ সালের জার্মান ফেডারাল কনস্টিটিউশনাল কোর্ট (BVerfG) রায়ে বলা হয়:
NPD-এর মতাদর্শ সংবিধানবিরোধী, তবে
তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব এতটাই দুর্বল যে তারা রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য প্রকৃত হুমকি নয়।
(ক) NPD নিষিদ্ধকরণ মামলা:
মামলার নাম: BVerfG, Urteil des Zweiten Senats vom 17. Januar 2017 – 2 BvB 1/13বিষয়বস্তু: জাতীয়তাবাদী দল Nationaldemokratische Partei Deutschlands (NPD)-কে নিষিদ্ধ করার চেষ্টায় আদালত রায় দেয় যে দলটি অসাংবিধানিক মতাদর্শ প্রচার করলেও বাস্তবে রাষ্ট্রের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ হুমকি নয়, তাই নিষিদ্ধ করা হয়নি।পূর্ববর্তী রায় (২০০৩): তথ্যদাতার অতিরিক্ত হস্তক্ষেপের কারণে মামলাটি খারিজ হয়।
(খ) Holocaust Denial Case:
আসামি: Ernst Zündelহলোকাস্ট অস্বীকার করে তিনি বিভিন্ন প্রচারপত্র ও বই প্রকাশ করেন।অভিযোগ: §130 অনুসারে “Volksverhetzung” বা ঘৃণা উসকে দেওয়া।আদালত রায় দেয়, ইতিহাস বিকৃতি ও ঘৃণা ছড়ানো কোনোভাবেই বাকস্বাধীনতা দিয়ে আচ্ছাদিত নয়।
(গ) নাৎসি প্রতীকের ব্যবহার মামলাঃ
BVerfG, 1 BvR 817/02 (2004):এই মামলায় আদালত বলে, শিল্প বা রাজনৈতিক প্রতিবাদের অংশ হিসেবে হলেও নাৎসি প্রতীক ব্যবহার সীমাবদ্ধ করা যাবে যদি তা গণতন্ত্র ও সামাজিক শান্তি বিঘ্নিত ।
~কাওসার আহমেদ