ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর তাজুলের আবেগঘন শুনানি

ডেস্ক রিপোর্ট:

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক চার্জশিট দাখিল করেছেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।

রোববার চার্জশিট দাখিলের সময় তিনি বলেন, ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় মুহূর্তে ট্রাইব্যুনালের এই কক্ষে দাঁড়িয়ে নিজেকে শুধু একজন আইনজীবী হিসেবেই নয় বরং ইতিহাসের এক তাজা রক্তাক্ত অধ্যায়ের সশ্রদ্ধ ভাষ্যকার হিসেবে নিজেকে তুলে ধরছেন।

তিনি বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের নারকীয় বীভৎসতা বাংলাদেশ ও বিশ্ব বিবেককে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার উগ্র বাসনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার করে ব্যাপক ও পদ্ধতিগতভাবে আক্রমণের মাধ্যমে সংঘটিত নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ ও সহিংসতা বাংলাদেশকে পরিণত করেছিল ৫৬ হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত একটি বধ‍্যভূমিতে। জাতির ইতিহাসের সেই বেদনাদায়ক অধ্যায়ে সংঘটিত অপরাধের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতেই এই বিচার শুরু করা হলো। যেখানে নিরস্ত্র, নিরীহ সাধারণ নাগরিক, বিশেষ করে তরুণ ছাত্র-যুবা, নারী ও শিশু- যারা একটি ন্যায়ভিত্তিক ভবিষ্যতের জন্য বৈষম্য ও কোটা পদ্ধতি নামক কু-প্রথার অবসানের দাবিতে অহিংস ও ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল।

২৪-এর এই আন্দোলনে বৈষম্যবিরোধী ও সরকারের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারী অসংখ্য নিরীহ, নিরস্ত্র ও সাধারণ মানুষ এই মামলার অভিযুক্ত আসামিগণ কর্তৃক নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ও ভয়াবহ সহিংসতার শিকার হন। আসামিদের নির্দেশে ও তাদের নেতৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণে থাকা রাষ্ট্রীয় বাহিনী, রাজনৈতিক দল ও সহযোগী সংগঠনের সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত হয় হত্যা, অঙ্গহানি, গ্রেপ্তার, নির্যাতন, গুম, চিকিৎসা প্রদানে বাধা এবং মৃত ও জীবিত মানুষকে একত্রে পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো ।

চিফ প্রসিকিউটর আদালতে বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব যা ‘মনসুন রেভুল্যুশন’ বা ‘বর্ষা বিপ্লব’ নামেও পরিচিত। এই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল দেড় দশক ধরে চলমান রাজনৈতিক নিপীড়ন, মানবাধিকার হরণ ও রাজনৈতিক উগ্রপন্থার মাধ্যমে সৃষ্ট গভীর সামাজিক বিভাজনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে আসামিদের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে বৈধ চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেওয়া তরুণদের অবিস্মরণীয় জাগরণ নির্মূল করার উদ্দেশ্যে আসামিরা সমস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ওইসব মুক্তিকামী ছাত্র-জনতাকে নির্মূল বা স্তব্ধ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যাপকভিত্তিক এবং পদ্ধতিগত আক্রমণ চালায়।

তিনি বলেন, উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়- এটি ছিল হাসিনার একটি পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ যা রাষ্ট্রের প্রশাসনযন্ত্র, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, অন্যান্য বাহিনী, সরকারি দলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং তাদের অধীনস্থ সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠীসমূহ এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনে অংশ নিয়েছে। এই বিচার শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ই নয় বরং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন’, ‘রোম স্ট্যাটিউট অফ দি আইসিসি’ এবং বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আইন অনুসারেও বিচারযোগ্য।

গতকাল ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য যে সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা হয় সেগুলো হলো, প্রত্যক্ষদর্শী ও জীবিত ভিকটিমদের সাক্ষ্য, অপরাধ সংঘটনের সময় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ, ড্রোন এবং সিসিটিভি ফুটেজ, আসামিদের মধ্যে টেলিফোন সংলাপের অডিও ক্লিপস, ডিজিটাল এভিডেন্সসমূহের ফরেন্সিক রিপোর্ট, আসামিগণের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত তথ্য, ছবি এবং ভিডিও, জাতীয় আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের প্রস্তুতকৃত রিপোর্ট, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে প্রাপ্ত অফিশিয়াল ডকুমেন্টস ইত্যাদি।

মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, এই বিচার কেবল অতীতের প্রতিশোধ নয়। এটি ভবিষ্যতের জন্য প্রতিজ্ঞা । প্রমাণ করতে হবে, এটি এমন একটি সভ্য সমাজ, যেখানে থাকবে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন। সহ্য করা হবে না গণহত্যা কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধ । যে দেশে বিচারে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না।

বিচার কাজ শুরুর আগে চিফ প্রসিকিউটর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন জুলাই বিপ্লবের সব ভিকটিমদের। বিশেষ করে যারা নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। স্মরণ করেন, আন্দোলনে চোখ, হাত, পা কিংবা শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ হারানোদের। স্মরণ করেন সেই সব অকুতোভয় মানুষদের, যাদের অপরিসীম ত্যাগের কারণে এই রাষ্ট্র অন্ধকার থেকে আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে।

চিফ প্রসিকিউটর আরো বলেন, এই আদালত এমন একটি সময়ের সাক্ষ্য বহন করছে- যা ইতিহাসের এক অনন্য দলিল হয়ে থাকবে । তিনি বলেন, এ বিচার হবে নিরপেক্ষ, প্রমাণনির্ভর এবং ন্যায়ভিত্তিক। এ বিচার শুধু বাংলাদেশের সামাজিক জীবনে সৃষ্ট গভীর ক্ষত মুছে না দিক, বরং এটি হোক এক আত্মাভিমানী জাতির ঐতিহাসিক পুনর্জাগরণ।

Share