মোহাম্মদ মাহবুব হোসাইন
পাহাড়, ঝরনা, ঘন সবুজ অরণ্য প্রকৃতির সব সৌন্দর্যই যেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য। এরপরও যদি কারও অতৃপ্তি থাকে, তার জন্য রয়েছে শাটল ট্রেন। বাংলাদেশে একমাত্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্যই ট্রেন রয়েছে। ট্রেনে চড়ে ক্যাম্পাসে যাওয়ার সুযোগ আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নেই।
এখন যাঁরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন, তাঁরা চাইলে প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের নিয়েও ভীষণভাবে গর্ববোধ করতে পারেন। ইতিহাস ঘেঁটে কারও নাম খুঁজে বের করার দরকার নেই। এখন দেশের সর্বোচ্চ আদালত, জনপ্রশাসন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃত্বে রয়েছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের তালিকার কয়েকটি নাম দেশময় বেশ আলোচিত ছিল।এদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন, নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক।
দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। সবচেয়ে কম বয়সে ব্যাঙের নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করে বিশ্বস্বীকৃতি পাওয়া সাজিদ আলী হাওলাদার এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাক্তন ছাত্র।
আজ থেকে নয় বছর পূর্বে গৌরবের সেই বিদ্যাপিঠ চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ বছরের পূর্তি পালিত হয়।সেই সময় চট্টগ্রাম জুড়ে সাজ সাজ রব পরে যায় ।
এ উপলক্ষে জিওসি কনভেনশন হলের মেজবানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন উপাচার্য মহোদয় বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিবাদী আওয়ামীলীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পিতা একদলীয় বাকশালের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের গুণকীর্তন করেছেন। তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে হালকা পাতলা রসিকতায় সবাইকে হাসিয়েছেন।সবাই যার যার প্রতিক্রিয়ায় অনেকেরই নাম উচ্চারণ করেছেন ; কেবল একজন মানুষের নাম কেউ ঘুনাক্ষরে মুখে আনেননি; যিনি গেইম অফ থ্রোনস এ জিতে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।যিনি না থাকলে সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে এই অঞ্চলের মানুষ কল্পনাও করতে পারতোনা।
১৯৫৮ সাল, ফিল্ড মার্শাল আইযুব খান পূর্ব পাকিস্তানেৱ গর্ভনর হিসেবে জাকির হোসেনকে নিয়োগ দেন। জাকির হোসেন গভর্নর এ,কে,এম ফজলুল কাদের চৌধুরীকে তাঁর প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করেন।এই সময় তৈরী হচ্ছিল দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনায় ফজলুল কাদের চৌধুরীর আপ্রাণ প্রচেষ্টায় চট্টগ্রাম বিভাগে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করিয়ে নেন । সমস্যা দেখা দিলো এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে চট্টগ্রাম বিভাগে আর তৎকালীন চট্টগ্রাম বিভাগের বিস্তৃতি ছিল আজকেৱ কুমিল্লা নোয়াখালী হয়ে সিলেট পযর্ন্ত।এই কারনে সমস্যা আরো গভীরতর হয়।
১৯৬০ এর শেষের দিকে জাকির হোসেনকে সরিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুহাম্মদ আজম খানকে এখানকার গভর্ণর পদে নিয়োগ করলে ফজলুল কাদের চৌধুরীর হাত থেকে বিশ্ববিদ্যালয় করার সুযোগ ফসকে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নে ‘ বিভাগ’ শব্দটি সংযুক্ত থাকায় চট্টগ্রাম বিভাগের বিশেষ করে সিলেট ও কুমিল্লা জেলায় আন্দোলন শুরু করে।
১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের এক পর্যায়ে সিলেট ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ছাত্রদের দ্বারা ঘেরাও হন। অবস্থা বেগতিক দেখে গভর্নর আজম খান গাড়ি থেকে বের হয়ে তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গীমায় ঘোষণা দেন, “এয়ে থার্ড ইউনিভার্সিটি হযরত শাহ জালাল (রাঃ) ক্যা মুলক সিলেটমে হুগা’’। অর্থাৎ হযরত শাহজালাল (রাঃ)’র দেশ সিলেটেই তৃতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হবে ।ব্যস শেষ সুযোগও হাতছাড়া হয়ে যায়।
ফজলুল কাদের চৌধুরী দৃঢ়চেতা ও সাহসী মানুষ ছিলেন। তিনি সহজে দমে যাওয়ার মানুষ ছিলেন না।১৯৬২ সালেৱ বিশাল নির্বাচনী এলাকায় (সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম, রাউজান, হাটহাজারী, রাঙ্গুনিয়া উপজেলা) ফজলুল কাদের চৌধুরী দৃঢ়তার সাথে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, “আমি নির্বাচিত হই আর না হই, তবে বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে স্থাপনের সকল প্রচেষ্টা আমি নেব এবং ইনশাআল্লাহ আমার এই উদ্যোগে সাফল্য অর্জন করবই।”
সামরিক সরকারের নির্ধারিত সিদ্ধান্তেৱ বিৱুদ্ধে গিয়ে এমন কথা বলার সাহস কেবল তারই ছিল।সৌভাগ্যক্রমে তিনি নির্বাচনে জিতেন। যদিও তখনও সব কাগজে কলমেচুডান্ত হয়নি। তবে সবাই সে সময়ে ঠিকই বুঝতে পেরেছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র কৱে গোটা শহর বদলে যেয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে।
কুমিল্লা জেলা হতে মফিজ উদ্দিন আহমদ প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী (১৯৬২-৬৫) হওয়ায় পর পরিস্থিতি আরো প্রতিকুলে চলে যায়।তিনি কুমিল্লায় প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনের জোর লবিং ও আন্দোলন শুরু করেন। সিলেটবাসীও তাদের দাবিতে সোচ্চাৱ হতে থাকে ; অপরদিকে প্রাদেশিক গভর্ণর আবদুল মোনেম খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নে সিলেট কুমিল্লার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। এমনি এক নাজুক অবস্থায় ফজলুল কাদের চৌধুরী একটি কঠিন কৌশল গ্রহন করলেন। সিদ্ধান্ত নিয়ে মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিলেন এবং এই কৌশলে জিতে জাতীয় পরিষদের স্পীকার নির্বাচিত হন।
ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান দেশ ছাড়ার সময় তিনি পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিও ছিলেন।রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকালে তিনি প্রথম ও একমাত্র যে কাজটি করেছিলেন, তা হলো বিশ্ববিদ্যালয়কে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে স্থাপনের অর্থ অনুমোদনে স্বাক্ষর করা।
এর পরও বিপদ কাটেনি।বিশ্ববিদ্যালয় প্রশ্নে অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, সমৃদ্ধশালী সিলেটবাসীর বৈদেশিক অর্থের বিনিময়ে সরকারের অর্থ সাশ্রয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অর্থ জোগানের প্রস্তাব দেয়। গভর্নর মোনেম খান এতে মৌন সম্মতি দিয়ে বুঝিয়ে দেন যে, সিলেটেই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হবে । ফজলুল কাদের চৌধুরী তখন কোপেনহেগেন সফরে ছিলেন।পৱিস্থিতি অনেকটা আওতার বাহিরে চলে যায়।সেই মূহুর্তে ফজলুল কাদের চৌধুরী তাঁর সুহৃদ আবুল খায়ের সিদ্দিকীকে টেলিফোনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নে যেকোন কিছু করার অনুমতি দিয়ে বলেন “আমি কোপেনহেগেন থাকাকালীন শুনতে চাই যে, আপনি চট্টগ্রামেই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা ঘোষণা দিয়েছন”।
আবুল খায়ের সিদ্দিকীকে গর্ভানৱ মোনেম খান স্পষ্ট বলে দিলেন, “২৫ লক্ষ টাকা প্রাথমিক ফান্ড আজকের মাধ্যেই জমা দিতে হবে নচেৎ বিশ্ববিদ্যালয় সিলেটে চলে যাবে।”সেকালে ২৫ লক্ষ টাকা মূল্যমান আজ কত টাকা হয় তা নিশ্চয় বলে দিতে হবে না।হাতে মাত্র কয়েকটা ঘন্টা । আবুল খায়ের সিদ্দিকী এই কটা ঘন্টায় ফান্ড সংগ্রহেৱ জন্য বের হলেন এবং সমুদয় টাকা সংগ্রহ করে জমা করলেন।উল্লেখ্য, চট্টগ্রামেৱ সুলতান আহমদ, এম এ জলিল, হাজী আব্দুর রাজ্জাক, হাজী জানু, আলহাজ্ব ইসলাম খান, এম এম ইস্পাহানী মির্জা ও আবু আহমদ প্রমুখ ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছ থেকে এই ফান্ড সংগ্রহ করা হয়।
সেই কারনে এই ৫০ তম প্রতিষ্ঠা বাষির্কীতে উল্লেখিত মানুষগুলোর কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ না করে সেই সময়ের বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য কিংবা সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ অন্যায় করেছে।শুধু তাইনা ৫০ তম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী’র দিন কেউ ঘুনাক্ষরে উপমহাদেশের বরেণ্য ব্যাক্তিত্ব রাজনীতিবিদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ ফজলুল কাদের চৌধুরী’র নামটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি।এর মূল কারন হলো, তিনি ছিলেন উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বকীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম লীগের বরেণ্যনেতা ও বর্ষীয়ান পার্লামেন্টেরিয়ান শহীদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পিতা ।
স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকারের সময় প্রথম জেলহত্যা সংঘটিত হয় ১৯৭৩ সালের ১৮ জুলাই। পরিবারের কাছে থেকে অভিযোগ আছে, এ দিন বিষাক্ত ইনজেকশন পুশ করে হত্যা করা হয় কারাবন্দী রাজনৈতিক নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীকে।
ষড়যন্ত্র কিংবা নোংরা মানসিকতার আবরনে যতই তাঁর নাম আমরা মুছে ফেলার অপচেষ্টা করা হোকনা কেনো; ইতিহাস তাকে তাঁর যথাযথ স্থানেই স্বমহিমায় ধরে রাখবে অনন্তকাল।
লেখকঃ সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।